দেশরক্ষার যুদ্ধের সফল মুক্তিযুদ্ধা ‘তাহেরআলী বীরবিক্রম’ এর জীবনযুদ্ধে ব্যর্থতার কথোপকথন
প্রকাশিত হয়েছে : ১:১৭:৪২,অপরাহ্ন ০৪ জানুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৬২৫ বার পঠিত
মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন : ক্যাপ্টেন শেখ মোহাম্মদ তাহের আলী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আছে তার গর্ব করার মতো যুদ্ধের গল্প যা রুপকথাকেও হার মানায়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের ৪৮ বছরেও পাওয়া না পাওয়ার আক্ষেপে তার মনে জমা হয়েছে অনেক কষ্ট। একান্ত আলাপে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে জীবনের নানা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সে সব কষ্টের কথাও জানালেন তাহের আলী।
১৯৭১সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে তিনি পাকিস্তান সরকারের অধীনে ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে চট্রগ্রামে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের ক্র্যাকডাউনের পর তিনি সরকারের সাথে বিদ্রোহ করে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। প্রতিরোধ যুদ্ধ চলাকালীন তিনি ১নং সেক্টরের অধীনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশ গ্রহন করেন। জুলাই মাসে তিনি জেড ফোর্সের অধীনে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। সে সময় তার ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার ছিলেন মেজর এ.জে.এম.আমিনুল হক এবং কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আমিন আহমদ চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন মোবাশ্বের হোসেন খান।
স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন তুমুল আকার ধারণ করে সে সময় তিনি কোম্পানী গ্রæপ কমান্ডার হিসেবে চট্রগ্রামের কালুর ঘাট ব্রীজ,কালুর হাট সোনালী ব্যাংক, মদিনার হাট, আনোয়ারা থানা, কালোপুল ইস্পাহানী, কোর্ট বিল্ডিং ১ হতে ১২ জেটি পর্যন্ত, চন্দ্র ঘোনা, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, কাপ্তাই,খাগড়াছড়ি বাজার, মহলছড়ি, বন্দুকছড়ি, মইকারী, মহাজনপাড়া, রামগড়, শুভপুর, নারানহাট, হেয়াকো,ও খাগড়াছড়িতে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। তিনি রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম ও চিলমারিতে এবং সিলেটের সিলেট শহর, হরিপুর ও কানাইঘাট, কইলাশ^র, মৌলভীবাজার জেলার ফুলতলা চাবাগান, তেলিয়াপাড়া চা বাগান, লাতু, শাহবাজপুর, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল সহ বিভিন্ন স্থানে তিনি পাকহানাদার বাহিনী,রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সাথে প্রকাশ্য সম্মুখযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন।এপ্রিল মাসে তিনি চট্রগ্রামের কালুরঘাট ব্রিজে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে এক সম্মুখযুদ্ধে গুরুতর আহত হন। কিন্তু আহত শরীর নিয়েই চুড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে এনইে অবশেষে ক্ষান্ত হোন সেনাবাহিনীর চৌকস এ্যাথলেট ও বক্সার প্রশিক্ষক শেখ মোহাম্মদ তাহের আলী।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতার স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি বীর বিক্রম খেতাবে ভ‚ষিত হোন। কিন্তু দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ: করা এই যুদ্ধাকে মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতিটুকু পেতে ১৯৯৫সাল পর্যন্ত অপেক্ষা বরতে হয়েছে ।
সেনাবাহিনী হতে অবসর গ্রহনের পর জীবিকার জন্য নিজ এলাকা সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার হাতিম গঞ্জের কিছমত মাইজবাগে শুরু করেন কৃষি কাজ। সেই থেকে কৃষি কাজ করে পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কয়েক বছর হলো অসুস্থ হয়ে পড়ায় কৃষি কাজ করতে পারছেন না। সেই থেকে ভাঙ্গা ঘরে তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানকে নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে তাকে। কোন রকমে দুঃখ কষ্টে তিন কণ্যাকে পাত্রস্থ করতে পেরে কিছুটা সস্থিতে থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা ভাতার উপর নির্ভর করেই কোন রকমে চলছে তার বর্তমান দিনগুলো।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভাতা ছাড়া তেমন কিছু পাইনি। বসবাসের ঘরটাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। মেরামত করার মতো টাকা নেই। মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কল্যানে আমার মতো বীর বিক্রম খেতাবধারী অনেক ঢাকায় ফ্লাট বাড়ী পেয়েছেন, নিজ এলাকায় অনেককে সরকারী খরচে টাওয়ার নির্মান করে দেয়া হয়েছে কিন্তু আমার ভাগ্যে সেসবরে কিছুই ঝুটেনি।
তিনি বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে গিয়ে জীবন বাজি রেখে লড়াই করে জয়ী হয়েছি। স্বাধীন দেশ পেয়েছি। বর্তমানে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যেতে দেখে ভাল লাগছে।’
তার সবচেয়ে বড় আক্ষেপ, তার চার সন্তানের জন্য তিনি কিছইু রেখে যেতে পারছেন না। এজন্য তার মনে অনেক কষ্ট। সরকারের কাছে তার চাওয়া- এককালীন আর্থিক সহযোগীতা ও একটি সরকারী বাসস্তান বরাদ্দ পাওয়া। পরিবারের একটু নিশ্চয়তা দেখে যেতে চান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধা শেখ মোহাম্মদ তাহের আলী বীরবিক্রম এর বিবরণে নিজের কষ্টের ও পাওয়া না পাওয়ার কথা গুলোর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে তার সাথে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহন কারী সহযোদ্ধাদের কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কুলাউড়ার জয়পাশার সাহসী যুদ্ধা আব্দুর রাজাাক চৌধুরী যিনি জীবন বাজি রেখে ব্রীজ ভাঙ্গাসহ অনেক বড়বড় অপারেশনে শ্রীমঙ্গল,ফুলতালা ধামাই, লাটিটিলা ও শাহবাজপুর, ফাটারপুল ব্রীজ এলাকায় আমাদের সাথী যুদ্ধা ছিলেন যিনি আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতিটুকুও পাননি। একই ভাবে সিলেটের গোলাপ গঞ্জের জামাল হোসেন, জকিগঞ্জের আব্দুল মালেক, শামছুল হক, আব্দুস শহীদ, ফয়জুর রহমান ও মঈনউদ্দিন ময়না সহ আমার সাথী অনেক সহযোদ্ধা স্বাধীনতার ৪৮বছর পেরুলেও আজোবধি মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতি টুকুও পাননি। এরা সকলেই জাতীর শ্রেষ্ট সন্তান অথচ পরিবার পরিজন নিয়ে তাদের অভাবের সাথে যুদ্ধ আজো অব্যাহত আছে, এদের অনেকের মাথাগুজার ঠাইটুকুও নাই দেখে অনেক কষ্টপাই। নিজেকে একজন ব্যর্থ মুক্তিযুদ্ধা মনে হয়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী : বীর মুক্তিযুদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত অনারারী ক্যাপ্টেন শেখ মোহাম্মদ তাহের আলী বীর বিক্রম ০৫/০৬/১৯৪৫ সালে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার হাতিম গঞ্জের কিছমত মাইজবাগ গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ২৪/০২/১৯৬৩ সালে তিনি সাধারণ সিপাহি হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ল্যান্স কর্পোরেট অফিসার হিসাবে ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের আন্ডারে চাকুরি শুরু করেন। ১৯৬৫সালে যুদ্ধকালীন সময়ে মেজর মঞ্জু, হবিগঞ্জের ক্যাপ্টেন কামাল ও শেখ মোহাম্মদ তাহের আলীর নেতৃত্বে রংপুর দহগ্রাম আঙ্গুর পোতা দখল অভিযান সফল ভাবে সমাপ্ত হয়। ১৯৬৫সালের যুদ্ধের পর ট্রেনিং এর জন্য পাকিস্তানের শিয়ালকোর্টে ৫ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন তিনি। তার পরে উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন রাইফেল্স এর ট্রেনিংএর জন্য তিনি পাকিস্তান পেশোয়ারে যান। তার পরে তাকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। সেখানে এফসিএল এর কোয়ালিফাইড ইঞ্জিনিয়ার এর প্রশিক্ষন সম্পন্ন করে আবার দেশে ফেরত আসেন।১৯৬৬ সালে তিনি সেনাবাহিনিতে বক্সার ও এথলেট প্রশিক্ষককের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া ও টিক্কা খানের উপস্থিতিতে সেনাবাহিনীর এক সভায় বর্ডার ফোর্সের কমান্ডিং মেজর আব্দুর রশিদ জাওয়াদ আইদা তার বক্তব্যে দাবি করে বলে যে, তাকে কমান্ডিং করলে নাকি সে শেখ মুজিবের ও ভাসানীর রক্ত দিয়ে গোসল করবে । সে সময় একমাত্র সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে ক্যাপ্টেন শেখ মোহাম্মদ তাহের আলী তার প্রকাশ্য প্রতিবাদ করেছিলেন।
১৯৭৫সালের ১৫ই আগষ্ট জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার দিনেই শেখ মোহাম্মদ তাহের আলীর ফুল ক্যাপটেন র্যাঙ্কের পরীক্ষা ছিল । বঙ্গবন্ধুকে সপরবিারে হত্যার কারণে পরীক্ষা পরের দিন অনুষ্টিত হয়। তিনি চাকুরেিত সর্বশেষ অনারারী ক্যাপটেন হিসেবে ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন।। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি তিনি অনারারী ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় উন্নীত হোন ও ১৮মার্চ ১৯৯৩সালে তিনি সেনাবাহিনী হতে অবসর গ্রহন করেন।