‘হত্যা ও ধর্ষণের সত্যতা হারিয়ে যায় ফাইনাল রিপোর্ট ‘-অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:২৩:১৩,অপরাহ্ন ১৩ জানুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৪৬৬ বার পঠিত
দশটি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অভিযোগের সত্যতা মিললেও সবগুলোতেই ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে পুলিশ। এত সমাজের একটি শ্রেণী বিচার পাচ্ছেনা, এটা ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘন।
ঊষারবাণী ডেস্ক : রাজধানীর কাফরুলে ২০১৬ সালের মার্চে গৃহকর্মী জনিয়াকে (১৫) ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় কাফরুল থানায় প্রথমে অপমৃত্যুর মামলা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। ঐ ঘটনায় এলাকাবাসী আন্দোলনও করেছিল। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে জনিয়ার মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করা হয়। পাওয়া যায় ধর্ষণের আলামতও। অথচ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কামরুজ্জামান ঐ বছরের ডিসেম্বরেই আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দেন। রিপোর্টে তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি হত্যাকাণ্ড বলে প্রতীয়মান হয়নি। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতাও মেলেনি। এটি আত্মহত্যা, এখানে কোনো অভিযুক্ত নেই।’
গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে এমন অন্তত ১০টি গৃহকর্মী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, সবগুলো ঘটনাতেই পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে। রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরের এই ঘটনাগুলোর অভিযোগকারী দুর্বল হওয়ায় কোনো প্রতিবাদও কেউ করেননি। ফলে ফাইনাল রিপোর্টেই হারিয়ে গেছে এসব হত্যাকাণ্ড এমনকি ধর্ষণের অভিযোগও। কয়েকটি ঘটনায় পুলিশ কিছুদিন অনুসন্ধান চালানোর পর থেমে গেছে। কখনও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে, কখনও মামলার চাপে এই মামলাগুলোর দিকে নজর দেওয়ার সময়ই পায়নি।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা ইত্তেফাককে বলেন, ‘ভিকটিম দুর্বল হওয়ার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলার বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে পারেন না। আর এই সুবিধাটাই নেয় তদন্তকারী অফিসার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগও আমি অস্বীকার করব না। তবে সিনিয়র অফিসারদেরও দায় আছে। ঠিকমতো সুপারভাইজ না করতে পারার ব্যর্থতা তাদের। অভিযোগকারী যতই দুর্বল হোক, বিচার পাওয়া তার অধিকার। সেটা আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না। এই ব্যর্থতা আমাদের সবার।’
২০১৬ সালের মে মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নির্মম নির্যাতনে মারা যান গৃহকর্মী হাসিনা। কাজে দেওয়ার চার মাসের মাথায় তার মৃত্যু হয়। ১১ বছর বয়সী হাসিনার সমস্ত শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। ময়নাতদন্তে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলেও আলামত পাওয়া যায়। রিকশাচালক আব্দুস সোবাহান হাসিনার বাবা। মেয়ে মারা যাওয়ার পর ঢাকা ছেড়ে এখন নেত্রকোনায় গ্রামে চলে গেছেন সপরিবারে। সোবহান বলছিলেন, ‘আমার বাড়ি নাই, ঘর নাই কিছু নাই। বাচ্চাডারে লইয়া দুই জামাই বউ গেছিলাম ঢাহায়। ভাবছিলাম সুন্দরভাবে চলবো। হেই বাচ্চাডারে কীভাবে মারলো হে কি মানুষ না পশু?’ এই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি অপমৃত্যুর মামলা করা হয়। মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল লতিফ ইত্তেফাককে বলেন, থানায় এই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। নথিপত্রে মামলার কথা উল্লেখ নেই। অপমৃত্যুর মামলা হয়েছিল, সেটির হয়ত ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। তবে নথিপত্রে এ বিষয়ে কিছু নেই।
২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারী তারিখে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মনবাজার ইউপির চকের গ্রামের বাসিন্দা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি মুচি সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র বাসন্তি রোহিদাস পূর্ব শত্রুতার জেরে পার্শবর্তী ইউছুফ-গণি কলেজের(বর্তমানে এমএ গণি কলেজ) প্রভাষক শাহ আলম সরকার(বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ) ও প্রভাষক এএনএম আলম কতৃক নির্মমভাবে ধর্ষন ও শারিরীক নির্যাতনের স্বীকার হোন। ডাক্তারী রিপোর্ট অনুযায়ী ৪৫ বছর বয়স্ক ২ সন্তানের জননী বিধবা বাসন্তীর শরীরে ধর্ষনের ও নির্যাতনের আলামত ছিল। আদালত কর্তৃক চুড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য পিবিআই মৌলবীবাজারের পুলিশ পরিদর্শক মুহিতুল ইসলামকে দায়িত্ব দিলে তদন্তে তিনি বলেন, ধর্ষনের সত্যতা মিলেনি, এটাকে তিনি ইচ্ছাকৃত কারো সাথে শারিরীক সম্পর্ক বলে উল্লেখ করেন এবং ধর্ষনকে সম্পুর্ণ আড়াল করে ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করেন। এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবি জুনেদ আলী দৈনিক সংবাদকে বলেন, “প্রতিবেদনে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টকে আড়াল করা হয়েছে তা ছাড়া ৪৫বছরের ২সন্তানের জননীর শরীরে অবিবাহিত মহিলার শরীরের মতো ধর্ষনের আলামত থাকার প্রশ্নই উঠেনা। পিবিআই ধর্ষক পক্ষের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই এ প্রতিবেদন দিয়েছে।”
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র উপপরিচালক নীনা গোস্বামী ইত্তেফাককে বলেন, ‘এটা উচ্চবিত্তদের সঙ্গে নিম্নবিত্তদের লড়াই। এই লড়াইয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের টিকে থাকা কঠিন। ফলশ্রুতিতে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। যে মামলাটি হচ্ছে সেটার খোঁজ–খবর রাখা এই নিম্নবিত্ত মানুষদের পক্ষে দীর্ঘসময় ধরে রাখা সম্ভব না। ফলে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী শেষ পর্যন্ত আর অনুসন্ধান না করেই ফাইনাল রিপোর্ট দিচ্ছে।’
গুলশান–২ নম্বরের ৬২ নম্বর বাড়ির ৫ তলা থেকে ২০১৮ সালের ১১ মে এক বৃদ্ধা গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শাহেরা বানু নামে ঐ গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদনে মাথায় ও শরীরে আঘাতের কথা উল্লেখ করে। এই ঘটনায়ও বৃদ্ধা শাহেরার পক্ষ থেকে কেউ কোনো মামলা করেনি। পুলিশ একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছিল। গুলশান থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান ইত্তেফাককে বলেন, ‘বৃদ্ধাকে নির্যাতনের কোনো আলামত না পাওয়ায় গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। মামলাটির তদন্ত করেছেন এসআই শহীদুল ইসলাম।’
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ পৌর শহরের সোনালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওয়ালিউর রহমানের বাড়ি থেকে পুলিশ ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আনু সম্পা (১৭) নামে এক গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় গৃহকর্মীর বাবা আজগর আলী পরদিন দুজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। গৃহকর্তার ছেলে রেজা হুমায়ুন কবির ও কবিরের স্ত্রী উম্মে সেলিনাকে আসামি করা হয়। আজগর আলীও পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দা। আজগর আলী অভিযোগ করেন, তার মেয়েকে ঐ বাড়ির লোকজন প্রায়ই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতেন। মৃত্যুর এক বছর আগেও তার মেয়ের গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। আশপাশের বাসিন্দারা সম্পার চিত্কারে বাড়িতে চলে আসায় সেবার প্রাণে রক্ষা পায়। শেষ পর্যন্ত মেয়েকে তিনি বাঁচাতে পারলেন না। এ দফায় মেয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে মোবাইল ফোনে জানিয়ে বাড়ির লোকজন পালিয়ে যান। এই ঘটনাটিতেও ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে পুলিশ। ঘটনার আড়াই মাসের মাথায় এসআই মগবুল হোসেন আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দেন। এখানে হত্যার আলামত পায়নি পুলিশ।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমাদের বিচারব্যবস্থাও ধনীদের পক্ষে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো এর বাইরে নয়। তারাও উচ্চবিত্তদের পক্ষ নিয়ে এই গুরুতর অভিযোগের বিষয়েও ফাইনাল রিপোর্ট দিচ্ছে। সমাজে একটা শ্রেণি কোনো বিচার পাচ্ছে না। এটা ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন। রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই এই নিম্নবিত্ত শ্রেণির আইনি অধিকার পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এক্ষেত্রে সঠিক দায়িত্ব পালন করছে না। কোনো ঘটনায় মিডিয়া সোচ্চার হলে তখন দেখা যাচ্ছে পুলিশ সঠিক তদন্ত করছে। অন্যথায় নানাভাবে সুবিধা নিয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করছে।’
একইভাবে ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি রামপুরার বনশ্রী এলাকার ৪ নম্বর রোডের ৩৫ নম্বর বাসা থেকে গৃহকর্মী মুন্নী আক্তারের (১৫) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রামপুরা থানার তত্কালীন এসআই মাজহারুল ইসলাম লাশের সুরতহাল করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, মেয়েটির শরীরের একাধিক জায়গায় পোড়া ক্ষত রয়েছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে সন্দেহ হয়।’ পরে বাড়ির গৃহকর্ত্রী নাজমুন নাহারকে আটক করে পুলিশ। এই ঘটনায়ও অপমৃত্যুর মামলা হয়। ফলে কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই ফাইনাল রিপোর্টে হারিয়ে গেছে হত্যাকাণ্ড। থানার বর্তমান অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কুদ্দুস ফকির নথিপত্র ঘেঁটে ইত্তেফাককে বলেন, ‘এই মামলার কোনো তথ্য থানায় নেই। অপমৃত্যুর মামলা হওয়ায় আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।’
গৃহকর্মীদের নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস (বিলস)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক নাজমা ইয়াসমিন ইত্তেফাককে বলেন, ‘এই চিত্রটা এত ভয়াবহ যে একটা মামলারও যদি আমরা রেজাল্ট না আনতে পারি তাহলে তো মানুষ ভাববেই যে আমরা যে ধরনের অপরাধ করছি এটা করে আমরা পার পেয়ে যাব, আমাদের বিত্ত দিয়ে ঢেকে ফেলব। এটাই ঘটছে এবং দিনে দিনে এই ভয়ানক নির্যাতনটা বেড়ে যাচ্ছে।’