প্রবাসীরা এদেশের সূর্যসন্তান, তাদের ত্যাগ ও অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রাখুন
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:৩১:০০,অপরাহ্ন ২৯ মার্চ ২০২০ | সংবাদটি ১১৪৪ বার পঠিত
মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন : সম্প্রতি বিশ্বব্যাপি করোনা ভাইরাস মহামারী আকার ধারন করার প্রভাবে বাংলাদেশেও চরম আশঙ্কাগ্রস্থ অবস্থা বিরাজমান। এই কঠিন দূর্যোগ মোকাবেলায় দেশের সরকার ,জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন সমুহ, প্রবাসী, সেনাবাহিনী, পুলিশ বিজিবি সবাই এক কাতারে কাজ করে যাচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতিতে সংক্রমনের হাত হতে নিজেকে রক্ষার প্রয়োজনে প্রচুর প্রবাসীর বাংলাদেশে আগমন ঘঠেছে। প্রবাসীদের এইমুহুর্তে দেশে আগমনকে নেতিবাঁচক দৃষ্টিতে নিয়ে অনেকেই ফেসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রবাসীদের ট্রল করছেন যা অনাকাঙ্খিত, অনভিপ্রেত ও দুঃখজনকও বটে। প্রবাসীরা এদেশেরই নাগরিক, এদেশের অর্থনীতির চাকার চালিকাশক্তি, অক্সিজেন বলা চলে। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে এদেশের সকল দূর্যোগ, বন্যা মাহামারী সহ সকল দূর্বিপাকে প্রবাসিরাই তাদের পরম মমতায় ভালবাসা পূর্ণ সাহায্যের হস্ত আমাদের প্রতি প্রসারিত করেছেন। যারা নিজেদের জীবন ও য়ৌবনকে বাজি রেখে,পরিবার পরিজনের সান্নিধ্য ও ভালবাসাকে বিসর্জন দিয়ে এদেশ পূনর্গঠনে অবদান রেখে যাচ্ছেন। তাদের থেকে নির্যাস টুকু চুষে খাব আর দূঃসময়ে ছুড়ে ফেলে দিব সেটা তো কখনো কাঙ্খিত নয়, অমানবিকও বটে।
এমনি প্রেক্ষাপটে দেশে আগত প্রবাসীদের প্রতি ভালবাসা, মমত্ববোধ প্রদর্শন না করে, চরমঅশ্রদ্ধাশীল আচরণ করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করা থেকে সবারই বিরত থাকা উচিত। হ্যাঁ ,পরিস্থিতির মোকাবেলায় হোমকোয়রেন্টাইনের শর্ত শুধু প্রবাসীদের জন্য নয়, এদেশের সবার জন্য প্রয়োজ্য। আর সকল প্রবাসীই যে ভাইরাস সংক্রমনরোধের নিয়ম লংঘন করছেন তা কিন্তু মোঠেও নয় । যারা অজ্ঞতা বশত: বা সচেতনতার অভাবে সেটা মানছেননা তাদেরকে তো আমাদেরই বুঝানো উচিত, সচেতন করে তুলা উচিত, এরা তো আমাদেরই আপনজন, কারো ভাই, বাবা, চাচা, স্বামী ,স্ত্রী ইত্যাদি। তাই এ নিয়ে দোষারূপ, কাঁদা ছুড়াছুড়ি মোঠেও সমীচীন নয়।
প্রবাসীদের জীবন নিয়ে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই, নিজ পরজিন ও পারিপার্শিক অভিজ্ঞতায় প্রবাসীদের আবেগ অনুভূতি বেশ বুঝতে পারি সেটাবলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রবাসীর জীবন সত্যিই বেদনাদায়ক, যেখানে থাকে নিয়ত নির্ঘুম রাত, ছুটে চলা বাস-ট্রেনের একটি ভোর, কাজে যাওয়ার তাড়া, মালিকের অসহ্য কুরুচিপূর্ণ ভাষা, ক্ষুধার্ত দুপুর, অবসন্ন একটি বিকেল। তারপর ক্লান্ত গোধূলিলগ্নে চোখ কপালে তোলা শুকিয়ে যাওয়া সাদা ঠোঁটের মলিন মুখ। কাজ শেষে আসে সোডিয়ামের আলোয় ঘরেফেরা বেদনার্ত রাত। যদি এইসব অনুভূতি প্রিয়জনের হাতে তুলে দেওয়া যেতো, তাহলে প্রবাসীর সুখের সাথে চোখের জল কি আটকাতে পারতো আপনজন!
‘বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার, আমার দেশ,
কেন গো মা তোর শুষ্ক নয়ন? কেন গো মা তোর রুক্ষ কেশ?’ (কবি দীজেন্দ্রলাল রায়)
আমার এঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি বাধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর। (পল্লীকবি জসীম উদ্দিন)
বঙ্গভূমির পীড়া দেখে, দুঃখ দেখে বিচলিত হয়ে বাংলার সন্তানেরা নিজ ভূমির দুঃখ ঘোচাতে ‘পৃথিবীর পথে’ বেরিয়ে পড়েছিলেন সেই কবেই। নিজমাতৃভূমি ছেড়ে, আত্মীয় পরিজন রেখে পৃথিবীর পথে ছড়িয়ে পড়া এই প্রবাসীরা শুধু ব্যক্তিক প্রয়োজনেই যাননি। দেশের প্রয়োজনেও গিয়েছেন তার প্রমাণ বাংলাদেশের অর্থনীতির চাঁকা ঘুরাতে তাঁদের অবদান।
উন্নত জীবনের আশায়, উচ্চশিক্ষার টানে কিংবা অন্য যে কারণেই বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে যাক না কেন, তাঁর মন পড়ে থাকে এই সুদামাটিতেই। আর এ কারণেই এখানে রেখে যাওয়া স্বজনদের, এখানকার মাটিকে তাঁরা কখনো ভুলতে পারেন না। নিজেদের কষ্টার্জিত উপার্জনের অর্থ নিয়মিত পাঠিয়ে তাঁরা এ দেশকে গড়ে তোলেন পরোক্ষে।
রাষ্ট্র সকল মানুষের কাজের নিশ্চয়তা দিতে পারলে কোন মানুষ প্রবাস নামক কারাগার বরণ করতো না। অনেকক্ষেত্রে আমরা দেখি প্রবাসে কারো মৃত্যু হলে তার লাশ পর্যন্ত দেশে ফেরত পাঠাতে অনেক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যা। দশজনের কাছ থেকে চাঁদা তুলে লাশের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়, যা অত্যন্ত লজ্জাকর, বেদনাদায়ক ও অনাকাংখীত। কারণ এ মানুষগুলো এত সংগ্রাম করলো নিজের ও দেশের জন্য অথচ রাষ্ট্র তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থাটুকু করতে পারলো না নিজ খরচে?
২০১৮-১৯ অর্থবছরেই যেমন প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেড়হাজার কোটি ডলারেরও বেশী অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এই রেমিট্যান্সের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। এই অবদান এতটাই যে, ২০০৮ সালে আমেরিকায় শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা যখন পুরো বিশ্বকে চোখ রাঙিয়েছে, তখন বাংলাদেশের জন্য বর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছেন প্রবাসীরা। কোনো অনুমাননির্ভর কথা নয়, সম্পূর্ণ গবেষণালব্ধ ফলাফল এটি।
বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি প্রবাসী বিশ্বের প্রায় ১৬০ টিরও অধিক দেশে কর্মরত আছেন। আর এই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১২ থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে চীনের স্থান দখল করবে বলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। প্রবাসী এসব শ্রমিক যে পরমিাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন, তা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় অর্ধেক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১২-১৩ অর্থবছরে আমাদের মোট বার্ষিক রেমিটেন্স এক হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারের ৬৩ শতাংশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে আমাদের মোট বার্ষিক রেমিটেন্স এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার এসেছে। অবশ্য ২০১৫-১৬ অর্থ-বছরের জুন পর্যন্ত এই পরিমাণ কমে হয়েছে এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার। গত ১০ বছরে এশিয়ার অন্যান্য দেশে রেমিটেন্সের পরিমাণ গড়ে যেখানে ছিল ৭.১ শতাংশ, সেখানে বাংলাদশে ছিল প্রায় ১২ শতাংশ। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শীর্ষ ১০টি রেমিটেন্স অর্জণকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৭ম অবস্থানে।
শুধু অর্থের বিচারেই প্রবাসীদের অবদান বোঝা সম্ভব নয়। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা এক কোটি বাংলাদেশি বেকারত্বের সংকট মোকাবিলাতেও সরাসরি অবদান রাখছেন। রয়েছে তাঁদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক সংগঠন। অথচ এই সবকিছুর পরও এই প্রবাসীদের বিভিন্ন সময়ে নানা অবজ্ঞার মুখে পড়তে হয়। নিজ দেশে স্বজনদের কাছে যখন তাঁরা ফিরে আসেন, তখন থেকেই তাঁদের মুখোমুখি হতে হয় নানা হেনস্তার। বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক থেকে শুরু করে, বাংলাদেশি দূতাবাস, বাংলাদেশে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রবাসীরা নানা বিড়ম্বনার মুখে পড়েন। অথচ বাংলাদেশ এর সমাজ ও অর্থনীতিতে অবদানের বিপরীতে এটা কখনোই তাঁদের প্রাপ্য হতে পারে না। এটা সত্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার প্রবাসীদের কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে; কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
না, প্রবাসীরা কোনো প্রতিদানের আশায় দেশের অর্থনীতি ও সমাজে অবদান রাখেন না। তাঁরা এই অবদান রাখেন দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্বশীলতা থেকে। তাঁরা শুধু চান বাংলাদেশ তাঁদের আপন বলে জানুক। বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের বুকে টেনে নিক। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রতিনিয়ত চলমান রাখা এই প্রবাসী জনগোষ্ঠী শুধু চায় প্রতিদান না হোক, অবজ্ঞা যেন না করা হয়।
তাই আসুন, আমাদের প্রবাসী ভাই,বোন,বাবা,চাচা,মামা সহ সকল প্রিয়জনদের পরম মমতায় বুকে টেনে নেই, তাদের সার্বিক নিরাপত্থায় আরো বেশী সচেষ্ট হই, যারা নিজের জীবনের সবটুকু ভালবাসাকে চিতায় তুলে দিয়ে আমাদের সুখী করতে চেষ্ঠা করছে নিয়ত, তাই তাদেরকে নিয়ে নেতিবাচক ট্রল নয়, তাদের অবদান ও ত্যাগকে কৃতজ্ঞচিত্তে মূল্যায়ন করি।
লিখক : মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন,
সম্পাাদক,মানবতার জন্য ভাসানী ফাউন্ডেশন