বৃটিশ আমলের লাতু রেল ষ্টেশন সময়ের বিবর্তনে এখন গোয়াল ঘর!
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:১৩:৩৩,অপরাহ্ন ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | সংবাদটি ৪১১ বার পঠিত
ঊষারবাণী ডেস্ক : মান্ধাতার আমলের গোয়ালঘরের মতো মনে হলেও এটি একটি রেলওয়ে স্টেশন ! বৃটিশ পূর্ব ভারতবর্ষে এর নাম ছিলো “লাতু রেলওয়ে স্টেশন”। এখনো অনেকে এই নামেই ডাকছে, যদিও দেশভাগ তথা ১৯৬৫ সালের পাক্-ভারত যুদ্ধের পর অবিভক্ত ভারতবর্ষের স্মৃতি মুছে দিতে এর নাম হয় “শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশন”। কারণ, ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসের গণভোটে লাতুর বৃহৎ অংশটি ভারতে থেকে যায় এবং স্টেশনটি সহ কিয়দংশ চলে আসে পূর্ব্ব-পাকিস্তানে । অবিভক্ত ভারতে বৃটিশদের তৈরী ছিল এই স্টেশন । তৎকালীণ জলঢুপ থানা, বর্তমান বিয়ানীবাজার, বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার মানুষের কাছে ‘লাতু রেলস্টেশন’ নামে সমধিক পরিচিত ।
ব্রিটিশ আমলে ১৮৯৬ থেকে ১৮৯৮ সালে ত্রিপুরার কুমিল্লা-আখাউড়া-শ্রীহট্টের কুলাউড়া-বদরপুর রেলপথটি চালু করে তৎকালীণ আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে । এই রেলপথটি ১৯০৩ সালে আসামের লামডিং পর্যন্ত প্রসারিত হয় । ১৯০৪ সালে ১৬ই ফেব্রুয়ারী বাংলার গভর্ণর লর্ড কার্জন আনুষ্ঠানিকভাবে রেল লাইনটি উদ্বোধন করেন । চাটগাঁ বন্দরের রেল সংযোগের জন্য আসাম চা রোপণকারী সংঘের দাবির প্রতিক্রিয়ায় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ১৮৯১ সালে বাঙলার পূর্ব দিকে একটি রেলপথ নির্মাণ শুরু করে । চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার অধুনা কুমিল্লার মধ্যে ১৫০ কিলোমিটার পথ খোলা হয় ১৮৯৫ সালের রেলওয়ে ট্রাফিকে । ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সাথে এটি গুরুত্ব হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল । শ্রীহট্টের লোকজন এই রেললাইন দিয়ে করিমগঞ্জ, বদরপুর, হুজাই, লঙ্কা, লামডিং, শিলচর, গৌহাটি যাতায়াত করতেন । এ লাইনে চলাচলকারী ট্রেন যাত্রীসহ মালামাল বহন করত । ১৯১৯ সালের ৪ঠা নভেম্বর এই স্টেশন হয়েই শ্রীহট্টে পা রেখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
লাতু বা শাহবাজপুর স্টেশনের পরবর্তী স্টেশনের নাম ‘মহিশাসন’, যেটি অধুনা আসামের করিমগঞ্জের অংশ । মহিশাসন সীমান্ত রেলওয়ে স্টেশনটি ভারতের সীমান্তবর্তী করিমগঞ্জ জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত একটি সীমান্ত রেলওয়ে ট্রানজিট সুবিধা কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল । স্বাধীনতার নামে দেশভাগের পরেও এই স্টেশনটি ছিলো জমজমাট, হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলত ট্রেন, কিন্তু ১৯৬৫ সালে পাক্-ভারত যুদ্ধের সময়ে মহিশাসন-লাতু রেলওয়ে চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় । মহিশাসন-শাহবাজপুর(লাতু) রুটটি ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর থেকে চালুর কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় সংষ্কার ও রেলওয়ে ট্রাফিকের অভাবের কারণে চালু হয়নি ।
ভৌগলিকভাবে আসামের জাতিগোষ্টী, ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে আমাদের শ্রীহট্ট অঞ্চলের অনেক মিল রয়েছে । কুশিয়ারা নদীর তীরে তৎকালীণ করিমগঞ্জ ছিলো আমাদের মহকুমা শহর । এই মহকুমার অধীনে ৫টি থানা ছিলো যথাক্রমে করিমগঞ্জ, বদরপুর, জলঢুপ, রাতাবাড়ি ও পাথারকান্দি । সেই সময়ে শত শত মানুষ কাজের গন্তব্যে যেতে সময়ের আগেই এই স্টেশনে অপেক্ষার সময় কাটাতেন । মানুষের কোলাহলে মুখর সেই স্টেশনটি আজ গোয়ালঘরে পরিণত হয়েছে । কত শত সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমাদের এই লাতু স্টেশনটিতে । শত বৈরীতা স্বত্বেও কাঁটাতারের বেড়া উপেক্ষা করে যদি দুই পঞ্জাবের আঠারী-ওয়াগা সীমান্তপথ চালু থাকতে পারে, তবে এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলে কি লাতু-মহিশাসন রেলওয়ে চালু রাখতে পারি না ? অমৃতসর-লাহোর যদি পারে, তবে লাতু-মহিশাসন কেন নয় ? স্বাধীনতার নামে দেশভাগের সেই ক্ষত শুকোবে কবে, শুনতে কি পারব মৈত্রীর সেই হুইসেল ?
সূত্র : মোহাম্মদ মাসুক, সাবেক অধ্যক্ষ, ভূকশিমইল হাইস্কুল ও কলেজ এর ফেসবুক ওয়াল থেকে।