তার সমস্যা হলো, তার ব্যর্থতা এতটাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যা রাশিয়ার প্রোপাগান্ডা মেশিনের মতো ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ন্যাটোকে সম্প্রসারণ থেকে বিরত রাখতে তিনি আংশিকভাবে ইউক্রেন আক্রমণ করেছিলেন; সেই লক্ষ্য পূরণ না হয়ে উলটো ন্যাটো সম্ভবত তার আগ্রাসনের ফলস্বরূপ এ বছর দুটি নতুন সদস্যাকে স্বীকার করে নিচ্ছে। তিনি দুটি এলাকাকে পুনরায় একত্রিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয়রা একই জনগণ বলে মনে করেন; সেটা ঘটার পরিবর্তে তার নৃশংসতায় ইউক্রেনীয়রা নিশ্চিতভাবে চিরকাল নিজেদের রাশিয়া থেকে আলাদা মনে করবে এবং রাশিয়াকে ঘৃণা করবে। তিনি রাশিয়াকে সাম্রাজ্য ধরনের স্বাদ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তা না ঘটে বরং তিনি এটিকে একটি আন্তর্জাতিক বিশৃঙ্খলায় পরিণত করেছেন এবং এভাবেই ঘটনাক্রম চলছে।
কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে পুতিন যেভাবে যুদ্ধে হারতে যাচ্ছেন, সেটাই তার সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ হচ্ছে। ক্রমবর্ধমানভাবে ইউক্রেনীয়রা তার আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়ে উঠছেন। আর তাদের কাছে শুধু হেরে না যাওয়াটাই জয়ের শামিল।
পুতিন কি এই পরাজয় থেকে বাঁচতে পারবেন? কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি নিজেকে এই প্রশ্ন করছেন। সেটা রাজনৈতিক ও মাঠ পর্যায় উভয় বিষয়েই। তার মনস্তত্ত্ব এটা কীভাবে বিচার করছে? অতীতে পুতিন নিজেকে কোণঠাসা ইঁদুরের সঙ্গে তুলনা করেছেন: ইঁদুর হাল ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে আক্রমণ করে বসে। সে রকমই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি কখনোই পিছু হটবেন না। তিনি সামনে আগাবেন, এমনকি আত্মবিনাশের মধ্যেও।
পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় প্রবাহিত রাশিয়ান গ্যাস বন্ধ করে তিনি এই সপ্তাহে এক ধাপ আগাতে চেয়েছেন। এটি কোনো সামরিক পদক্ষেপ নয়। তবে এটি একটি ঐতিহাসিক প্রথম পদক্ষেপ। এমনকি স্নায়ুযুদ্ধের সময় সবচেয়ে শীতল পরিস্থিতিতেও সোভিয়েত ইউনিয়ন তার জ্বালানি রপ্তানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেনি। এর মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশেও পাইপের মুখ বন্ধ করে দিতে পারেন। এটা অর্থনৈতিক যুদ্ধ। আপনি বাজি ধরতে পারেন, এর সঙ্গে সাইবার যুদ্ধও বহাল থাকবে।
সামরিক দিক থেকে পুতিন ইতিমধ্যে তার যুদ্ধের লক্ষ্যগুলো একটি নতুন শিকারের ওপর ন্যাস্ত করতে চেষ্টা করছেন: শিকার দেশটি হলো মালদোভা। সমস্ত ইউক্রেন নিতে অক্ষম হয়ে তিনি শুধু এর পূর্ব ও দক্ষিণ নিয়ন্ত্রণে মনোনিবেশ করছেন। তার প্রাথমিক লক্ষ্য হলো ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করার জন্য একটি রাশিয়ান স্থল সেতু তৈরি করা। এই ক্রিমিয়াকে তিনি ২০১৪ সালে সংযুক্ত করেছিলেন। ডনবাস অঞ্চলটি এখন তার দখলের মধ্যে রয়েছে। আর সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য হলো কৃষ্ণসাগরের সঙ্গে থাকা পুরো ইউক্রেনীয় উপকূল দখল করা। এটি কিয়েভ দ্বারা শাসিত লেজের অংশটি দখলে নিয়ে ইউক্রেনকে একটি ল্যান্ডলক রাষ্ট্রে পরিণত করবে।
আরো গুরুত্বপূর্ণ, এই উপকূলীয় অঞ্চলকে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলোকে মালদোভার সঙ্গে সংযুক্ত করবে। মালদোভাকে জর্জিয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনকে সঙ্গে নিয়ে এই তিন রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করে পুতিন ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে যাবেন।
২০০৮ সালে তার আক্রমণের পর থেকে পুতিন আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেটিয়া নামক রাশিয়াপম্হি ছায়া রাষ্ট্র সমর্থন করে যাচ্ছেন। ইউক্রেনে তিনি লুহানস্ক ও ডোনেটস্কের ‘জনগণের প্রজাতন্ত্র’ স্বীকৃতি দিয়েছেন। মালদোভায় একই রকম রাশিয়ান অধু্যষিত বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার (অর্থাৎ ‘নিস্টার নদীর ওপারে’) অবস্থা।
অন্যান্য বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলোর মতো ট্রান্সনিস্ট্রিয়া অনেক জাতিগত রাশিয়ান ও রাশিয়ান সৈন্যদের আবাসস্থল। এই ঘাঁটি পুতিনকে ইউক্রেনে আরেকটি ফ্রন্ট খুলতে সাহাঘ্য করতে পারে। তবে এটি সমস্ত মালদোভা আক্রমণ করার অজুহাত তৈরির মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে, যেটা ইউক্রেনের ক্ষেত্রে ঘটেছে।
এই কয়েক সপ্তাহে ট্রান্সনিস্ট্রিয়ায় অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। সোমবার গ্রেনেড আঘাত; মঙ্গলবার রেডিওর টাওয়ার বিস্ফোরিত হয়; চিসিনাউতে মালদোভার সরকার অভিযোগ করেছে যে রাশিয়ান বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এ কাজ করেছে। অথচ রাশিয়ানদের দাবি, এই হামলাগুলো ইউক্রেন থেকে এসেছে।
দীর্ঘদিনের পুতিন পর্যবেক্ষকদের কাছে এই আখ্যান খুব পরিচিত শোনায়। ক্রেমলিন আক্রমণ করার অজুহাত হিসাবে ‘ফলস ফ্লাগ’ ঘটনাগুলো মঞ্চস্থ করতে পছন্দ করে। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে পুতিন উদ্ভাবন করতে পারেন মোলদোভায় জাতিগত রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’র গল্প। যেমনটি তিনি ইউক্রেন আক্রমণ করার আগে করেছিলেন।
ইইউতে গ্যাস বন্ধ করা বা আরো দেশ আক্রমণ করা পুতিনকে তার বিদেশি শত্রু এবং দেশীয় দর্শকদের কাছে বার্তা দিতে সাহাঘ্য করবে যে তার এখনো ক্রমবর্ধমান আধিপত্য রয়েছে। তিনি এখনো ইভেন্টগুলোর দায়িত্বে রয়েছেন। কিন্তু এসব তার বড় সমস্যা দূর করবে না। সমস্যাটি হলো, তার সৈন্যরা ক্রমবর্ধমানভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
একটি উদাহরণ হলো মারিউপোলের আজভস্টাল ইস্পাত কারখানা, যেটিকে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা বীরত্বের সঙ্গে রক্ষা করছে, যদিও আশপাশের শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুতিন তাদের আশপাশে বোমা মেরে তাদের ক্ষুধার্ত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইউক্রেনীয়রা এখনো সেখানেই আছে। কিন্তু তারপর কী?
পরিস্থিতি এখানেই ক্রমবর্ধমানভাবে ভয়ংকর হতে শুরু করে। পুতিন আজভস্টাল বা অন্য কোথাও রাসায়নিক, এমনকি কৌশলগত (অর্থাৎ, কম ফলন) পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। এটি তার পক্ষে সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে বিশেষ যুদ্ধ শেষ করবে। এটিও ইঙ্গিত দেবে যে তিনি পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে অস্তিত্বের প্রশ্নে হাত বাড়াতে প্রস্তুত। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সামরিক উপদেষ্টা ওলেক্সি আরেস্টোভিচ বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, মস্কো কতৃর্পক্ষের মধ্যে একটি কৌশলগত পারমাণবিক হামলার কথা ভাবা হচ্ছে।’
পরিস্থিতিগুলো এতটাই ভীতিকর যে এর প্রতিটি ঘটনার মধ্যে পুতিনের ক্রমবর্ধমান হতাশার লক্ষণও ফুটে উঠছে। এমনকি বিশেষত ক্রেমলিনের সীমিত পারমাণবিক হামলা কামিকাজের প্রতিরোধে নামতে হতে পারে।
এমনকি যদি পুতিন কোনোভাবে পরাজয় এড়ান, তবে তিনি রাশিয়ান জনগণের কাছে বিজয় বলে চালাতে চেষ্টা করবেন। আর এর মধ্যেই রয়েছে ট্র্যাজেডি :তিনি তার লক্ষ্য হাসিল করতে কত মানুষকে বিস্মৃতির অতলে পৌঁছে দিচ্ছেন, সেই খেয়াল তিনি করবেন না।
রোমান ঐতিহাসিক ট্যাসিটাসের কথা মনে পড়ে। তিনি কল্পনা করেছিলেন, একজন ক্যালেডোনিয়ান যুদ্ধনেতা রোমানদের আক্রমণের পর ব্রিটেনের ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তারা লুণ্ঠন করে, তারা কসাই করে, তারা লালসা করে এবং এটিকে “সাম্রাজ্য” নামে ডাকে। তারা একটি মরুভূমি তৈরি করে তাকে “শান্তি” বলে।’ আজ তিনি ইউক্রেন নিয়েও এ কথা বলতে পারতেন।
দ্য প্রিন্ট থেকে অনূদিত