দক্ষিণ লংলার শ্রেষ্ঠ বাতিঘর ‘লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজ’
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৪৬:০৫,অপরাহ্ন ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ১৩৪২ বার পঠিত
মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম , কুলাউড়া : ভাটেরা তাম্র ফলকদ্বয় প্রমান করে প্রাচীনকাল থেকে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলা শিক্ষা ও প্রযুক্তি শিক্ষায় এগিয়ে ছিল। আবহমান কাল থেকে নানা ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবাহে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সরোবরে এক অনন্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজ’। যা ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে একুশ বছরে পা রেখেছে। অতি অল্প সময়ে এ কলেজ একটি বাতিঘরে রূপান্তরিত হয়ে আলোকিত মানুষদের ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বময়। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর এ অঞ্চলের মানুষের শত বছরের প্রত্যাশার প্রাপ্তি ঘটিয়ে কুমিল্লা বোর্ড থেকে প্রথম স্বীকৃতি পায় উচ্চ মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘লংলা আধুনিক মহাবিদ্যালয়’ নামে। মাত্র ১৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা করে ছোট্ট চারা গাছ এখন বলিষ্ট বৃক্ষে পরিণত হচ্ছে। এর সাফল্যের ধারাবহিকতা অক্ষুন্ন থাকবে কালের যাত্রায়।
কুলাউড়ার দক্ষিণাঞ্চল শিক্ষা-দীক্ষায় আগ্রহী মানুষের অভাব ছিলনা। বৃটিশ-পূর্ব যুগে পাঠশালা, মক্তব ও টোলের প্রচলন ছিল। বৃটিশ আমলে পাঠশালাগুলো প্রাইমারি স্কুলে পরিণত হয়। এ অঞ্চলে সদপাশা নামকস্থানে সদপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৮৯০ সালে। পরে উচ্চ বিদ্যালয়ের পত্তন হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে আলী আমজদ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পরে অনেকগুলো উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হলেও দীর্ঘ শত বছরেও এখানে কোনো কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়নি। রবিরবাজারকে কেন্দ্র করে কলেজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছিল বেশ ক’বার। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে কলেজ প্রতিষ্ঠার বিঘ্ন ঘটেছিল। যার ফলে সামর্থ্যহীন শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছিল অকালে। তবে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে সম্মিলিত ভাবে কলেজ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়া হয়। বিচারপতি মিজবাহ উদ্দীন হোসেনের নামে কলেজের নামরণের প্রস্তাবও উঠে, কিন্ত ব্যক্তির নামে ব্যবহার করতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন; তহবিলের অভাবে এটি সম্ভব হয়নি। তারপরও গণ্যমান্য ব্যক্তিবৃন্দ ও এলাকার সাধারণ মানুষের প্রবল চেষ্টা সত্বেও এটি বিভিন্ন কারণে ব্যহত হয়।




জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কলেজ হিসেবে ‘লংলা আধুনিক মহাবিদ্যালয়ে’ নাম কিছুটা পরিবর্তন করে নাম হয় ‘লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজ’। দীর্ঘ একুশ বছর যাবৎ গভর্নিং বডির সঠিক দিক নির্দেশনায় শিক্ষকদের নিরলস প্রচেষ্টায় এ কলেজ শিক্ষার্থীদের সেবা দিয়ে আসছে পরম মমতায়। সহ শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা হচ্ছে মননশীল ও সৃজনশীল মানুষে। নিয়মিত স্কাউটের শিক্ষায় দীক্ষিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা রক্তদান কর্মসূচীতে রক্তদানে উৎসাহীত হচ্ছে। বিশ^ সাহিত্য কেন্দ্রের শাখা হিসেবে বই পড়া কর্মসূচীর মাধ্যমে ১৫ বছর ধরে শত শত পুরষ্কার ছিনিয়ে আনছে শিক্ষার্থীরা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ভ্রাম্যমান জাদুঘর প্রদর্শনী হয়েছে বেশ ক’বার। শিক্ষার্থী কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা সংগ্রহ করে জাদুঘরে পাঠানো হচ্ছে নিয়মিত। যার ফলে শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস চর্চায় ঘনিষ্ঠ হচ্ছে আর সম্পৃক্ত হচ্ছে জাতীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায়। নিয়মিত বিতর্ক, বক্তৃতা, সাধারণ জ্ঞান, কবিতা আবৃত্তি ও সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বর্ণাঢ্য আয়োজনে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সপ্তাহ উদ্যাপন করা হয়। ২০০৬ ও ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে মৌলভীবাজার জেলা আন্ত:কলেজ ফুটবল টুর্নামেন্টে সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ ও ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে রানার আপ ট্রফি জিতে নেয়। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ১ম ইউএনও গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়ে গোল্ডকাপ ছিনিয়ে আনে। সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিযোগিতায় উপজেলা-জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে এ কলেজের শিক্ষার্থীরা সাফল্যের সাথে অংশ গ্রহণ করছে। প্রতিবছর শিক্ষা সফরও অনুষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা হয় সুজাত মোহাম্মদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, সমরেন্দ্র ভট্টাচার্য মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, ও লংলা ট্রাস্ট থেকে।
যে কলেজ মাত্র সতের জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সে কলেজে এখন সতেরশোরও অধিক শিক্ষার্থী। সন্ত্রাস, ধুমপান ও শিক্ষার্থীদের মোবাইলফোন মুক্ত শিক্ষাঙ্গন প্রতিদিন মনিটরিং করেন শিক্ষাঙ্গন ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা উপ-কমিটি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হৃৎপিন্ড হলো গ্রন্থাগার অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে গ্রন্থাগার সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালিত না হলেও নিয়মিত ২০/২৫ জন শিক্ষার্থী বই আদান-প্রদান করে, প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত শিক্ষক মন্ডলীর সঠিক পদ্ধতিতে পাঠদান, কর্মচারীদের সেবমূলক কর্মকান্ড, শিক্ষার্থীদের একাগ্রতা, গভর্নিংবডির সদস্যদের দিক নির্দিশনা ও ভালবাসা, গভর্নিং বডির সভাপতি ও সাবেক এমপি আব্দুল মতিন ও সম্পাদক আতাউর রহমান, অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) এর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নে লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজ এগিয়ে যাচ্ছে বিশ^মানের শিক্ষা দিয়ে নিরাপদ বিশ^ বিনির্মানের লক্ষ্যে।
২০০০ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ মাধ্যমিক এম.পি.ও. হলেও ডিগ্রি পর্যায় এমপিও এখনও হয়নি। এ কলেজের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মূলত: কলেজটি চারদিকে গ্রাম বেষ্টিত, গ্রামের শিক্ষার্থীরা অনেক বঞ্চনা নিয়ে উঠে আসে, সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীরাই কম জি.পি.এ নিয়ে আসে। সুবিধা বঞ্চিতা পরিবারের অনেক শিক্ষার্থীরা দিনমুজুরীর কারণে অনুপস্থিত থাকে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়েপড়া শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে গিয়ে কলেজ অনেক উন্নয়নমূলক কাজে পিছিয়ে আছে। তদুপরি কলেজের একুশ বছর পূর্তিতে গণমানুষ পেশাজীবী শুভাকাংখি প্রতিষ্ঠাতা, প্রতিষ্ঠাকালীন বিভিন্ন স্কুলের প্রধান ও শিক্ষকগণ, দাতা, গভর্নিং বডির সদস্য, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী সহ সকলের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা। এ লেখায় অনেকেরই নাম আসেনি আগামীতে বড় পরিসরের লেখাগুলোতে আসবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- “তথ্যের চেয়ে সত্য বড়”। সব শেষে দেশ মাতৃকার জন্য যারা রক্ত দিয়েছেন জীবন দিয়েছেন ও কলেজ প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান ছিল সেই সব প্রয়াতদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম
সিনিয়র প্রভাষক, লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজ ও
সম্পাদক সময়ের সাথে২৪.কম