বরমচালে গৃহবধুর ভাসমান লাশ উদ্ধার; রহস্যঘেরা মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছেনা নিহতের পরিবার
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৫৫:৩৯,অপরাহ্ন ২৪ অক্টোবর ২০১৯ | সংবাদটি ২৪৩১ বার পঠিত
কুলাউড়া প্রতিনিধি (সরেজমিন প্রতিবেদন) : মৌভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নে নিখোঁজের ৫ দিন পর গত ২৮ সেপ্টেম্বর শনিবার বিকেলে নাজমীন খানম (৪৫) নামক গৃহবধুর ভাসমান লাশ নিহতের শশুড় বাড়ীর অনতিদুরে ফানাই নদীর মরাগাং এলাকা থেকে উদ্ধার করে কুলাউড়া থানা পুলিশ। নিহত নাজমীন খানম বরমচালের উত্তর রাউৎগাঁও ইটাছড়া (মাঝিপাড়া) গ্রামের হান্নান মিয়ার ৪র্থ স্ত্রী। পুলিশ ও নিহতের স্বামীর পরিবারের দাবি নাজমীন মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। কিন্তু নিহতের স্বজনরা নাজমার এরকমের মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে নারাজ। তাদের ধারণা নাজমিনকে খুন করা হয়েছে।
পুলিশ ও নিহতের স্বামীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ২২ সেপ্টেম্বর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে নাজমিনকে তাঁর মামর বাড়ী ছোট বোনের কাছে দিয়ে আসেন স্বামী হান্নান মিয়া। ২৩ সেপ্টম্বর সকাল থেকে নাজমীনের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তাঁর স্বামীসহ স্বজনরা অনেক খোঁজাখুজি করেন। শুক্রবার ২৭ সেপ্টেম্বর কুলাউড়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেন নাজমীনের ছোট বোন জাহান জেসমিন খানম। ২৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয়রা নাজমিনের শশুড় বাড়ীর গ্রামের পাশে বরমচাল মাধবপুর লামাপাড়া গ্রামের পুর্বে এবং চিলারকান্দি গ্রামের পশ্চিমে মরা ফানাই নদী এলাকায় একজন নারীর লাশ দেখতে পেয়ে কুলাউড়া থানায় খবর দিলে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করলে নাজমীনের লাশ বলে নিশ্চিত করেন তাঁর স্বজনরা।
অপর দিকে নাজমিনের স্বজন ও পিত্রালয় সূত্রে জানা যায়, আজ থেকে ৭বছর পূর্বে ইসলামি শরীয়া মোতাবেক কাবিননামা সম্পন্ন করে হান্নান মিয়ার সাথে বিয়ে হয় নাজমিনের। শুরুতে তাদের সংসার খুব ভালই কাটছিল। কিছুদিন যেতেই ধরা পড়ে হান্নানের আসল পরিচয়। নাজমিন জানতে পারেন তার স্বামী বহু বিবাহে আসক্ত। নাজমিনকে বিয়ে করার আগেই হান্নান মিয়া আরো তিনটি বিয়ে করেছেন। প্রথমে বরমচাল সিংগুর গ্রামের কুটি মিয়ার(কালা কুটি) মেয়ে কাঞ্চন বেগমের সাথে বিয়ে হয় হান্নানের। আফজাল নামে তাদের একটি ছেলেও রয়েছে। হান্নানের ও তার পরিবারের যৌতুক লোভী মানসিকতা ও নির্যাতনের কারণে এক পর্যায়ে মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে নেন কাঞ্চনের বাবা। তবে তাদের মধ্যে আজোবধি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি। এর পর ভাটেরা ইউনিয়নের সিংহনাদ এলাকার আখলু মিয়ার ( আখলু গার্ড) মেয়ে রাজনা বেগমকে বিয়ে করেন হান্নান। তার তরফে হান্নানের রেহানা বেগম নামে এক মেয়ে ও কাশেম নামে এক ছেলে রয়েছে। দুটি সন্তান পেয়েও সংসার স্থায়ী হয়নি বিয়ে পাগল হান্নানের। বউকে রেখেই বরমচালের বদরুল হোসেনের বোন সুখি বেগমকে বিয়ে করে ৩য় বিয়ে সম্পন্ন করে হান্নান। তখন ২য় স্ত্রী রাজনা বাবার বাড়ীতে চলে গেলে আর স্বামী গৃহে ফিরেনি। এক পর্যায়ে বাবার বাড়ীতেই মারা যায় হান্নানের ২য় স্ত্রী রাজনা।
নিহতের স্বামী হান্নান মিয়া
নিহতের স্বজনরা নাজমার বছরে দু’একবার কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ইহা নাজমিনের স্বাভাবিক জীবন যাপনে কখনোই প্রতিবন্ধক ছিলনা। তাছাড়া সে চুড়ান্ত মানসিক ভারসাম্যহীন হলে দীর্ঘ ৭বছর সংসার চলার প্রশ্নই উঠেনা। তবে এরকম ভারসাম্যহীন হওয়ার জন্য স্বামীকেই দায়ী করেন নাজমিনের পরিবার। বিয়ের পর হান্নান বলপূর্বক নাজমিনকে স্থায়ী বন্ধাকরন করান যাতে তার সন্তান না হয়। সেটাকেও মেনে নিয়ে হান্নানের আগের স্ত্রীর সন্তানদের মাঝেই নিজের মাতৃত্বের শান্তনা স্বরুপ তাদের লালন পালন করেন নাজমিন। কিন্তু সন্তানরা বড় হলে তাদের আচরণ নাজমিনের কাছে অচেনা মনে হতে থাকে। হান্নান ও তার ছেলে মেয়ে সকলেই প্রায় সময় নাজমিনকে মারপিট করতো। এক সময় নিজের গর্ভজাত সন্তান না পাওয়ার তীব্র মানসিক যন্ত্রনা ও পারিবারিক নির্যাতন নাজমিনকে কিছুটা ভারসাম্যহীন করে তুলে।
নাজমিনের পরিবার থেকে আরো জানা যায়, হান্নানের ছোট ভাই আব্দুল করিমও প্রায়শই নাজমিনকে শারিরিক নির্যাতন করতো। হান্নান দুরে কোথাও গেলে তার ভাই করিমের ভয়ে নাজমিনকে বাড়ীতে না রেখে শশুড়বাড়ী রেখে যেত। গত ২০ সেপ্টেম্বর নাজমিনের ভাই আবুল কাশেম খান তার বোন নাজমিনের মোবাইলে কল করলে বোনের চিৎকার ও কান্নার শব্দ শুনতে পান। পরে কল কেটে দেয়া হলে পুনরায় কল দিলে হান্নান বাড়ীর বাচ্চাদের চেচামেচির শব্দ বলে জানায়। রাতে আবুল কাশেম বোনের খোঁজ নিতে হান্নানের বাড়ি গেলে নাজমিনকে শরীরে মাটি লাগানো, মাথার চুল ও শরীরের পোষাক অস্বাভাবিক এবং খুব বেশী বিধ্বস্থ অবস্থায় দেখেতে পান। জিজ্ঞাসা করলে সে কথা পর্যন্ত বলতে পারেনি। আবুল কাশেম তার বোন কে নিজের বাড়ীতে নিয়ে আসলে সে জানায়,আগের তরফের ছেলে কাসেম মিয়াকে ফরেষ্টে চাকুরি দেয়ার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল হান্নান ও তার ভাই করিম। ঐদিন সাবেক সচিব মামা ওমর আলীকে দিয়ে চাকুরি দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করলে সে বিষয়টি তার মামাকে বলতে রাজি না হওয়ায় হান্নান, তার ছেলে ও ভাই করিম মিলে নাজমিনকে প্রচুর নির্যাতন করেছে এবং প্রায়ই তারা তাকে নির্যাতন করতো। ২১ সেপ্টেম্বর বিকেলে কিছুটা স্বাভাবিক হলে নাজমিন কে তার স্বামী হান্নান নিজের বাড়ীতে নিয়ে যান। ২২ সেপ্টেম্বর নাজমিনকে তার মামা সাবেক সচিব ওমর আলীর বাড়ীতে ছোট বোন জাহান জেসমিনের কাছে দিয়ে যান হান্নান। পরদিন সকাল বেলা কাউকে না বলেই সেখান থেকে চলে যান নাজমিন। আগেও কাউকে না বলে প্রায়ই চলে যেতেন নাজমিন তবে স্বামীর বাড়ী ছাড়া অন্য কোথাও কখনোই যাননি।
নিহতের ভাই আবুল কাশেম বলেন, ‘হান্নানই আমার বোনেকে মেরে ফেলেছে। নিখোঁজ হওয়ার পর যতবারই তাকে নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছি, সে নিজ এলাকায় আমাদের খুঁজ করার সুযোগ না দিয়ে ভাটেরা, মাইজগাও,ফেঞ্চুগঞ্জ ও সিলেটে নিয়ে গিয়ে খোঁজ করিয়েছে। বিভিন্ন সময় সে নাজমিনের খবর পেয়েছে বলে আমাদের বিভ্রান্ত করে পরিকল্পিত ভাবে নিজের এলাকায় আসতেই দেয়নি। এমনকি তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে জিডি করাতে চাইলে সে জিডি করতে রাজি হয়নি তাই বাধ্য হয়ে আমার বোন জেসমিন জিডি এন্ট্রি করেছে।’
নিহতের ভাই আবুল কাশেম আরো বলেন, নাজমিনের লাশ পাওয়া গেছে বরমচাল মাধবপুর গ্রামের পূর্বে এবং চিলারকান্দি গ্রামের পশ্চিমে মরা ফানাই নদীর অত্যন্ত দূর্গম এলাকায়। এই জায়গায় পৌছতে কোথাও কোমর পানি, বুক পানি সাথে কাদাতো রয়েছেই। একজন শুস্থ সবল লোকও সেখানে পৌছা অনেক দুঃসাধ্য। নাজমিনের পক্ষে নিজে হেটে সেখানে পৌছা মোটেও সম্ভব নয়। তাছাড়া স্রোতহীন মরা নদীতে লাশ ভেসে যাওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। আর ভেসে গেলেও গাংগের ভাটি অঞ্চলে লাশ থাকার কথা অথচ গাংগের একদম উজান এলাকায় লাশ পাওয়া গেছে। সুতরাং নাজমিনকে খুন করে সেখানে কেউ ফেলে এসেছে।
নিহতের বোন জাহান জেসমিন খানম বলেন, ‘হান্নানের বাড়ীর পাশের নদীতে নাজমিনের লাশ পাওয়া গেলে সেটাকে হান্নান তার স্ত্রীর লাশ বলে মানতে রাজি হয়নি। বার বার সে বলেছে এটা অন্য কারো লাশ অথচ নিখোঁজের আগের দিন হান্নানের কিনে দেয়া নতুন মেক্সি লাশের পরনে ছিল। তার স্ত্রীর নাক ফুল দেখেও সে না চিনার ভান করেছে। পরে উপস্থিত সকলেই যখন নাজমিনের লাশ বলে সনাক্ত করেন তখন সে বাধ্য হয়ে তার স্ত্রীর লাশ বলে মেনে নেয়।’
জেসমিন আরো বলেন, নাজমিনের পরনের নতুন মেক্সির পিছনের দিকে ছিড়া ছিল যা কেউ তাকে ঝাপটে ধরতে গিয়ে ছিড়ে গেছে মনে হয়েছে। তাছাড়া লাশের মাথার ডানপাশে একটি আঘাতের মতো ক্ষত চিহ্ন ছিল এবং বুকের নিচের দিকে কালো দাগ ছিল।
নিহতের স্বামী আব্দুল হান্নান বলেন, নাজমিনকে পাগল জেনেই ৭বছর আগে তিনি বিয়ে করেছিলেন। স্বাক্ষী হিসেবে বিয়ের মধ্যস্থতাকারী (উকিল)ভাটেরা দেউলকাপন এলাকার দলামিয়া ও তার স্ত্রীর নাম উল্লেখ করেন। তবে নাজমিনের মানসিক ভারসাম্যহীন প্রমাণে কোন ডাক্তারী কাগজপত্র তার কাছে নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। হান্নান আরো বলেন, ‘নাজমিন নিখোজের পর সম্ভাব্য সকল জায়গায় খুঁজ করেও সন্ধান পাইনি।’ স্ত্রীর মৃত্যুর পিছনে কাউকে সন্দেহ করেন কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘নাজমিনের কোন শত্রু থাকতেই পারেনা। তাই কারো প্রতি তাঁর সন্দেহ নেই।’
হান্নানের বিয়ের মধ্যস্থতা কারী উকিল দলা মিয়া ও তার স্ত্রী জানান, ‘বিয়ের সময় নাজমিন স্বাভাবিক ছিল। বিয়ের কিছুদিন পরে সে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ছিল তবে এটাকে পাগল বলা যায়না। কারো সাথে কথা না বলে একটু নিরব থাকতো যা তার সাংসারিক জীবনে কোন সমস্যা করেনি।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কালাম টেপন জানান, ‘হান্নানের সাথে তার স্ত্রীর অত্যন্ত ভাল সম্পর্ক ছিল তবে তার স্ত্রী কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। লাশ উদ্ধারের সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। পুরো লাশ পঁচে যাওয়ায় কেউ তাকে হত্যা করেছে কিনা তা বুঝা যায়নি।’
বিভিন্ন গণমাধমের সংবাদ অনুযায়ী কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ইয়ারদৌস হাসান সাংবাদিকদের জানান, স্থানীয় সবার সাথে আলাপ করে জানা যায়, নাজমীন খানম মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। লাশ উদ্ধারের পর ময়না তদন্তে জন্য মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছিল। এব্যাপারে থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।
লাশ উদ্ধার কারী কুলাউড়া থানার এস আই রফিক বলেন, নিখোজের ৫দিন পর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশ অনেকটাই পচে যাওয়ায় নিহতের মৃত্যুর কারণ বিষয়ে কিছুই বলা যাচ্ছেনা। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলেই হত্যার কারণ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।