রমজানে সিন্ডিকেট ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি : ইসলামের হুঁশিয়ারি
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৩৪:৫৩,অপরাহ্ন ২৭ এপ্রিল ২০২০ | সংবাদটি ৬৭৪ বার পঠিত
ঊষারবাণী ডেস্ক : হালাল ও হারাম মুমিনের জীবনে খুবই গুরুত্ব বহন করে। কারণ হালাল গ্রহণ ও হারাম বর্জন হচ্ছে মুমিনের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআন ও হাদীসের নানা জায়গায় মুসলমানদের হালাল গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। আর উৎসাহ দেয়া হয়েছে নানাভাবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হয়ে যায়, তখন যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিযিক) সন্ধান কর’ (সূরা, জুমুআ-১০)
উল্লিখিত আয়াতে খোদাপ্রদত্ত রিযিককে আল্লাহর অনুগ্রহ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। বান্দার কাজ হচ্ছে, যখন জানতে পারে ওমুকটা প্রভুর অনুগ্রহ তখন তা লুফে নেয়া; মুখ ফিরিয়ে নেয়া নয়। উক্ত আয়াত দ্বারা মূলত খোদাপ্রদত্ত রিযিক তালাশের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। রাসুল (সা.)-ও বহু হাদীসে হালাল রিযিক উপার্জনের তাগিদ দিয়েছেন। যেমন এক হাদীসে এসেছে, হালাল রিযিক তালাশ করা, অন্যান্য ফরজ সমূহের পর একটি ফরজ।
ইসলামে হালাল গ্রহণের চেয়ে, হারাম বর্জনের প্রতি বেশি গুরুতারোপ করা হয়েছে। যেমন রাসূল (সা.) বলেন, যার শরীর হারাম দ্বারা ঘটিত হবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অন্য এক হাদীসে এসেছে, মুসলমানরা এক সময় বিপদে পড়ে দোয়া করবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের দোয়া কবুল করবেন না। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, ওদের কাপড়, পানাহার সবকিছু হারাম। তাহলে আমি কীভাবে ওদের দোয়া কবুল করবো !
রিযিক হালাল বা হারাম হওয়া উপার্জনের পদ্ধতির ওপর অনেকটা মাওকুফ। ইসলাম লেনদেনের ক্ষেত্রে এমন কিছু নীতিমালা দিয়েছে, যেগুলো মেনে না চললে মূল বিষয়টি বৈধ হওয়া সত্তেও প্রাসঙ্গিকতার কারণে লেনদেন অবৈধ হয়। এমন দুটি বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায় সিন্ডিকেট ও মজুদদারী করে সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেলা। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ব্যবসা হালাল। যেমন আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম।’ এক হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদী, আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন সিদ্দিক, শহীদ ও আওলিয়াদের সঙ্গে থাকবেন।’ কিন্তু কোনো ব্যবসায়ী যখন সিন্ডিকেট বা মজুদদারীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেলে দেয় তখন ওই ব্যবসা কোনো বৈধ বিষয় হিসেবে বিবেচ্য হয় না বরং আল্লাহর লানতের কারণ হয়। নিম্নে এ প্রসঙ্গে হাদীসের আলোকে আলোচনা তুলে ধরা হলো –
বাজার সিন্ডিকেট ও রাসূল (সা.) এর নির্দেশনা :
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন, ‘শহরগামী কাফেলার লোকদের থেকে আগে আগে পণ্য কিনে নেয়ার জন্য শহরের বাইরে গিয়ে ওদের সঙ্গে মিলিত হওয়া যাবে না। কোনো ব্যক্তি এ রুপ করলে, কাফেলার লোকেরা শহরে আসার পর এখতিয়ার থাকবে যে, বিক্রয় চূক্তিকে বহাল রাখবে নাকি রহিত করবে। (সহীহ মুসলিম শরীফ)
ব্যাখ্যা: রাসূল (সা.) এর যুগে সিস্টেম ছিলো, লোকেরা বিভিন্ন শস্য, ফল ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু গ্রাম থেকে শহরে এনে বিক্রি করতো। গ্রাম্য ব্যবসায়ীদের ওই সকল ছোট ছোট কাফেলাকে আরবী ভাষায় ‘জালব’ বলা হয়। শহরের চালাক ব্যবসায়ীরা ওই কাফেলাগুলো শহরে পৌছার আগেই তাদের থেকে পণ্য কিনে নিতো। এতে শহরে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন অসৎ উদ্দেশ্য থাকতো। প্রথম চিন্তা থাকতো এই যে, শহরের দাম দর জানার আগেই গ্রাম্য ব্যবসায়ীদের পণ্য কিনে নেয়া। তখন ওরা ওই গ্রাম্য ব্যবসায়ীদের থেকে কম দামে কিনতে পারতো। এটা এমন একটি বিষয়, বর্তমানে সব জায়গায় এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। দ্বিতীয় চিন্তা থাকতো আরো নিকৃষ্ট। তা হচ্ছে, বাইরের সকল মাল কিছু ব্যবসায়ীর হাতে নিয়ে নেয়া। যাতে জনগণের কাছে সর্ব্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি করা যায়। এবং বেশির চেয়ে বেশি লাভ কামানো যায়। সাধারণ ব্যবসায়ীরা যদি সরাসরি মাল বিক্রি করতো তাহলে মুনাসিব মূল্যে বিক্রি করতো। এতে সাধারণ ক্রেতাদেরও পোষতো এবং গ্রাম্য ব্যবসায়ীদেরও লাভ থাকতো। এ জন্য রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, শহরগামী কাফেলার লোকদের থেকে যেন আগে আগে পণ্য কিনে নেয়া না হয়।
আমাদের দেশের কৃষক শ্রেণী ন্যায্য মূল্য থেকে সর্বদা বিরত থাকে। দেখা যায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নামে মাত্র মূল্য দিয়ে গ্রাম্য কৃষক থেকে পণ্য কিনে নেয়। শহরে এসে ওই পণ্য বহুগুণ বেশি মূল্যে বিক্রি হয়। এতে শহরের সাধারণ জনগণও ন্যায্য মূল্যে পণ্য ক্রয়ের সুবিধা থেকে বিরত হয়। অথচ গ্রাম্য মানুষের পণ্য ওই সকল পুঁজিবাদী কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ীর হাতে না গিয়ে সরাসরি শহরের নাগরিকদের কাছে এলে উভয়ে লাভবান হতো।
রাসূল (সা.) বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে দালালিও নিষেধ করেছেন:
হাদীসটি আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন, শহরের ব্যবসায়ীরা যেন গ্রাম্য লোকের পক্ষ থেকে পণ্য বিক্রয়ের দায়িত্ব না নেয়। (সহীহ বোখারী ও মুসলিম)।
ব্যাখ্যা : শহরের বাজার কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকে। কোনো সময় যদি মালের আমদানি বেড়ে যায় তাহলে তা গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। নবী করীম (সা.) বাজার নিয়ন্ত্রনের জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বণ করতে নিষেধ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, গ্রামে যখন কোনো ফসল বেশি উৎপাদন হয় তখন শহরে ওই পণ্য বেশি আসা শুরু হয়। তখন শহরের ব্যবসায়ীরা গ্রাম্য লোকদের বলে, তোমরা আমাদের কাছে মাল রেখে যাও, কম দামে বিক্রি করো না। যখন দাম বাড়বে আমরাই তোমাদের পণ্য বিক্রি করে দেবো। এতে শহরের সাধারণ মানুষ কষ্টের শিকার হয়। তাই নবী করীম (সা.) এভাবে বাজার নিয়ন্ত্রন করতে নিষেধ করেছেন। এই হাদীস দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাজার নিয়ন্ত্রণ না করে স্বাভাবিক গতিতে তাকে চলতে দেয়া। এতে শহুরে ও গ্রাম্য লোক উভয়ে লাভবান হবে। কারণ, পণ্য যখন কম থাকবে তখন গ্রাম্য লোক বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হবে। আর যখন বেশি থাকবে তখন শহুরে কম দামে কিনে লাভবান হবে। এতে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিদ্যমান থাকবে। অন্যথায় গুটি কয়েক পুঁজিপতি লাভবান হবে আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভোক্তা ও কৃষক উভয়ে।
মজুদদারী ও ইসলাম:
বর্তমানে যেমন ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুদ রেখে কৃত্তিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ায়। এতে সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খায়। রাসূল (সা.) এর যুগেও এমন কিছু ব্যবসায়ী ছিলো, যারা কৃত্তিম সংকট তৈরি করে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করতো। রাসূল (সা.) একে অপরাধ সাব্যস্ত করে, এ কাজের জন্য কঠিন পরিস্থিতির সম্মুক্ষিণ হওয়ার হুশিয়ারী দিয়েছেন। যেমন-
(এক) হজরত মাআমার ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্নিত নবী করীম (সা.) বলেন, যে ব্যবসায়ী মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস মজুদ করে দাম বাড়ায়, সে গুনাহগার। (সহীহ মুসলিম)
(দুই) হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন, যে ব্যবসায়ী বাইরের পণ্য এনে বাজারে বিক্রি করবে, আল্লাহ তায়ালা তার রিযিকের জিম্মাদার । আর যে ব্যবসায়ী পণ্য মজুদ করে দাম বাড়াবে, সে আল্লাহর রহমত থেকে বিরত হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ ও দারেমী)
(তিন) হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন, যে ব্যবসায়ী মুসলমানদের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু মজুদ রেখে দাম বাড়াবে আল্লাহ তায়ালা তাকে শ্বেত রোগ ও দারিদ্রতা দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ)
ইসলামী শরীয়ত ও নবীর শিক্ষার মূল দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, বাজার ব্যবস্থা এমন হওয়া যাতে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে গরীব শ্রেণী যেন নির্যাতনের শিকার না হয়। ইসলামে ব্যবসায়ের নীতি হচ্ছে, গুটি কয়েক পুঁজিবাদীর হাতে সারা দেশের সম্পদ পুঞ্জিভূত হওয়ার ব্যবস্থা করার পরিবর্তে জনগণের কল্যাণ্যের চিন্তাকে অগ্রাধিকার দেয়া। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদেরকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে, দুনিয়াতে কম লাভে সন্তুষ্ট থেকে আখেরাতে অফুরন্ত নেয়ামত লাভের অপেক্ষায় থাকা। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে, ‘সত্যবাদী, আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন সিদ্দিক, শহীদ ও আওলিয়াদের সঙ্গে থাকবেন।’
মৌলিকত্বের দিক থেকে সুদ ও মজুদদারীর লাভ এক সমান :
গরীব অসহায় মানুষ বিপদে পড়ে সহযোগীতার জন্য ধনীদের কাছে আসে। কিন্তু ধনী ব্যক্তি সহযোগীতা না করে তাকে সুদভিত্তিক ঋণ দিতে চায়। আর বেচারা গরীব বাধ্য হয়ে তা নেয়। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে, ঋণগ্রহীতা সুদ স্বেচ্চায় দেয় না বরং বাধ্য হয়ে দিয়ে থাকে। আল কোরআনে এমন সম্পদ গ্রহণ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, ‘ হে ইমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদকে অন্যায়ভাবে গ্রহণ করো না, তবে তোমাদের পরস্পর সম্মতিক্রমে কোনো ব্যবসা হলে (তা গ্রহণ করতে কোনো সমস্যা নেই)।
ব্যবসার উদ্দেশ্যই হচ্ছে লাভ কামানো। তাই স্বাভাবিক লাভ ক্রেতা খুশিমনেই দিয়ে থাকে। কিন্তু মজুদদারী করে যখন পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো হয় তখন অতিরিক্তটা ক্রেতা স্বেচ্চায় দেয় না বরং বাধ্য হয়ে দেয়। যেমনটা সুদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। তাই মৌলিকত্বের দিক থেকে সুদ ও মজুদদারীর লাভ কাছাকাছি বিষয়। ইবনে খালদুনের বক্তব্য থেকেও বিষয়টা আন্দাজ করা যায়। তিনি তার মুকাদ্দামায় লেখেন ‘বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ লোকদের কাছে স্পষ্ট যে, মূল্য বৃদ্ধির অপেক্ষায় পণ্য মজুদ করে রাখা খারাপ লক্ষণ। এর দ্বারা লাভের পরিবর্তে ক্ষতিই হয়ে থাকে। এর কারণ হচ্ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের গুরুত্বের কারণে মানুষ এখানে অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য থাকে। অর্থ ব্যয় করার পরও ওই অর্থের প্রতি মানুষের আত্মার একটা সম্পর্ক থাকে। আর এই সম্পর্কই মসিবত আকারে প্রকাশ পায় ওই লোকের ওপর যে নাকি ফাও ফাও ওই অর্থ কামাই করেছে। সম্ভবত ইসলামী শরীয়ত বাতিল পন্থায় মানুষের মাল ভক্ষণ হিসেবে এটাকেও নির্ধারণ করেছে। (মুকাদ্দামায়ে ইবনে খালদুন-৪৭৮)
আমাদের মাঝে পবিত্র মাহে রমজান উপস্থিত। রমজান হচ্ছে সহমর্মিতার মাস। সাধারণ মানুষের কল্যাণকামীতার নাম হলো দ্বীন ইসলাম। ইবাদত কবুল হওয়ার শর্ত হচ্ছে হালাল ভক্ষণ। এ বিষয়গুলো সামনে রেখে, রমজান ও পরবর্তী সময়ে অর্থ উপার্জনের সকল অসৎ পন্থা আমরা বর্জন করবো। তাহলে দুনিয়াতে আল্লাহ আমাদের জীবনে শান্তি দিবেন। আর আখেরাতে দিবেন অফুরন্ত নেয়ামত।