বাঙ্গালী মুসলমানের বংশ পদবীর সাতকাহন (২য় পর্ব)
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:০৫:০৫,অপরাহ্ন ১৯ জুলাই ২০২০ | সংবাদটি ১৬৯৫ বার পঠিত
শেখ বংশের আদ্যপান্ত
মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন : শেখ আরব থেকে আগত পদবী। সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্মানসূচক বংশ পদবী হলো ’শেখ’। যিনি সম্মানিত বৃদ্ধ অথবা যিনি গোত্র প্রধান, তাকেই বলা হতো শেখ। হজরত মোহাম্মাদ (সাঃ) সরাসরি যাকে বা যাদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তিনি বা তার বংশ ধরও শেখ নামে অভিষিক্ত হতেন অথবা শেখ পদবী লাভ করতেন।
শেখ বা শাইখ (আরবি: شيخ বহুবচনে شيوخ) একটি সম্মানসূচক আরবি পদবি। এটি সাধারণত গোত্রপতিদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। গোত্রপতি তার পিতার পর এই পদবি প্রাপ্ত হন। বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের সাধারন পদবি হিসেবে ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে নারীদের ক্ষেত্রে “শাইখা” পদবি ব্যবহৃত হয়।
উৎপত্তি ও অর্থ
এই শব্দ আরবি অক্ষর ش-ي-خ শিন-ইয়-খা এর শব্দ মূল থেকে এসেছে। আক্ষরিক অর্থে এ দ্বারা বিপুল ক্ষমতা ও আভিজাত্যশীল ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। তবে এটি সুনির্দিষ্টভাবে মধ্য প্রাচ্যের রাজ পরিবারের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। আরবের গোত্রগুলোর মধ্যে তাদের নেতাকে শাইখ বলে সম্বোধন করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। আরব সভ্যতার সাংস্কৃতিক প্রভাব ও ইসলামের প্রসারের কারণে এই পদবি পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে, বিশেষত: আফ্রিকা ও এশিয়ার মুসলিম সংস্কৃতিতেও ধর্মীয় ও সম্মানসূচক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
মুসলিমরা ধর্মীয় ক্ষেত্রে শিক্ষিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে শাইখ পদবিটি ব্যবহার করেন। তবে আরবি শব্দ হিসেবে এর অন্যত্র ব্যবহার হয়। দ্রুজরা তাদের ধর্মীয় ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই পদবি ব্যবহার করে থাকে। একইভাবে আরব খ্রিষ্টানরা তাদের উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের শাইখ বলে সম্বোধন করে। ল্যাটিন ভাষার সেনেক্স যার অর্থ “বৃদ্ধ ব্যক্তি” এর সাথে আরবি শাইখের অর্থের মিল রয়েছে। সেনেক্স থেকে ইংরেজি “সেনেটর”বা “সিনেটর” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।
বাঙালি মুসলমান সমাজে যারা শেখ পদবী ধারণ করেন, তারা এ রকম ধারণা পোষণ করেন না যে, তারা বা তাদের পূর্ব পুরুষরা এসেছিলেন সৌদী আরব থেকে। বাঙালি সৈয়দ পদবী ধারীদের থেকে শেখ পদবী ধারীদের এখানে একটা মৌলিক তাৎপর্য্যগত পার্থক্য রয়েছে। শেখ পদবী গ্রহণের নেপথ্যে রয়েছে ওই পূর্বোক্ত চেতনা। নবীর হাতে মুসলমান না হলেও বাংলায় ইসলাম ধর্ম আর্বিভাবের সঙ্গে সঙ্গে যারা নতুন ধর্মকে গ্রহণ করে নেন ; নও মুসলমান’ হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে তারাই শেখ পদবী ধারণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের বংশের উত্তর সূরীরাই শেখ পদবী ব্যবহার করে এসেছেন। এমনিতে অন্য ধর্মের লোকের কাছে মুসলমান মানেই শেখ বা সেক। কেউ কেই শেখ কেউ সেক কিংবা কেউ শেখ এর রূপান্তর শাইখও ব্যবহার করে থাকেন।
শেখ পদবীর মূলে রয়েছে ধর্মীয় চেতনা, যা সম্মানসূচক মুসলমানের পদবী। এই উপমহাদেশে সুলতানী আমল, বৃটিশ আমল বা মোঘল আমলে রাষ্ট্রীয় ভাবে কাউকে এই পদবী প্রদান করা হয়নি। যা দ্বারা কেউ নিজেকে রাষ্ট্র প্রদত্ত পদবীধারী হিসেবে নিজেকে জমিদার কিংবা উপজমিদার বা ঐ জাতীয় কুলীন শ্রেণীভূক্ত বলে দাবী করতে পারেন। তবে ধর্মীয় চেতনাবোধ থেকে বাংলাদেশে অনেকেই নিজেদের বংশের পদবী শেখ,বা সেক বা শাইখ ব্যবহারের যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে শেখ পদবীযুক্ত বিখ্যাত ব্যক্তি : শেখ ফজলল করিম, শেখ সাদী খান, শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ নিয়ামত আলী, শেখ হামজা ইউসুফ, ফারুক শেখ,কাসিম শেখ, শেখ হাসিনা।
পরবর্তী পর্ব : চৌধুরী বংশ ও মজুমদার বংশের ইতিহাস……
লেখক : মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন, শিক্ষক,লেখক,গবেষক, মানবাধিকার কর্মী ও গণমাধ্যম কর্মী