বাঙ্গালী মুসলমানের বংশ পদবীর সাতকাহন (৩য় পর্ব)
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:২০:৫৫,অপরাহ্ন ২৯ জুলাই ২০২০ | সংবাদটি ২২১৯ বার পঠিত
চৌধুরী বংশের ইতিহাস ও মজুমদার বংশের ইতিহাস
মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন : সংস্কৃত ‘চতুধারী’ শব্দ থেকে এসেছে বাংলা চৌধুরী শব্দ। এর অর্থ চতু:সীমানার অন্তগর্ত অঞ্চলের শাসক। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমিদারদের পদবী হচ্ছে চৌধুরী। আবার অনেকে মনে করেন চৌথহারী’ যার অর্থ এক চতুথাংশ রাজস্ব আদায়কারী, সেখান থেকে উচ্চারণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে চৌধুরী’। সেদিক থেকে চৌথ আদায় কারী বা রাজস্ব আদায়কারী পদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থায়।
বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে, চতুর’ যার অর্থ তাকিয়া বা মসনদ, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধার’ (অর্থ ধারক) এবং এই দুয়ে মিলে হয়েছে চৌধরী’ আর তার থেকেই চৌধুরী’র উৎপত্তি। তবে তা মূলত হিন্দী ও মারাঠি শব্দ। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে চৌধুরী বংশ পদবী ব্যবহার করা হয় এদেশে। বৃটিশ-ভারতের প্রায় সর্বত্র এ পদবীর অস্থিত্ব ছিল। কারণ চৌধুরী ছিল সামন্ত রাজার পদবী।
চৌধুরী (হিন্দি: चौधरी; পাঞ্জাবী: ਚੈਧਰੀ; উর্দু: چودهرى; নেপালি: चौधरी 😉 ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত একটি পদবি। এর আক্ষরিক অর্থ “চারের মালিক”। এটি রাজকীয় বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যবহৃত সম্মানসূচক পদবি। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে এর প্রচলন রয়েছে।
এটি ছিল সামন্ত রাজার উপাধী।
এ বিষয়ে লিখিত বিবরণের মধ্যে সর্ব প্রাচীন নমুনা পঞ্চদশ শতকের। এটি দিল্লির সুলতানাত কর্তৃক ভারতীয় বংশোদ্ভূত সামরিক অভিজাতদের প্রদান করা হত। অর্থাৎ সুলতানী আমলে সামরিক উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের সালতানাতের মোহরাঙ্কিত সনদের মাধ্যমে এ পদবী প্রদান করা হতো। পরবর্তীতে তাদেরই উত্তরাধিকারগণ বংশ পরম্পরায় ইহা ব্যবহার করেন।
আবার মুঘল ও ব্রিটিশ ভারতে একটি তালুক বা জেলা সাধারণত ৮৪টি গ্রাম ও একটি কেন্দ্রীয় শহর নিয়ে গঠিত হত। তালুকদারদের কাজ ছিল খাজনা সংগ্রহ করা, প্রাদেশিক সরকারকে রসদ ও লোকবল সরবরাহ করা এবং বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজ সম্পাদন করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তালুকদাররা সংগৃহিত করের ১০% নিজস্ব প্রয়োজনে বরাদ্দ করতে পারতেন। তবে কিছু অধিক সুবিধাপ্রাপ্ত তালুকদাররা এক চতুর্থাংশ রাখার অধিকার পেতেন। এর ফলে তাদেরকে ‘চৌধুরী’ পদবী দেয়া হয়। অর্থাৎ আদায়কৃত করের অধিক সুবিধাপ্রাপ্ত তালুকদাররাই মূলত ‘চৌধুরী’ খোতাবপ্রাপ্ত। এসকল জমিদাররা ঔপনিবেশিক সময়ে নিজেদের সম্ভ্রান্ত অবস্থা বোঝাতে চৌধুরী পদবী ব্যবহার করতেন। ঐতিহ্যগতভাবে এই পদবী দ্বারা ভূমির মালিকানা স্বত্ব বোঝালেও সমসাময়িক কালে বংশপদবী হিসেবে ইহা ব্যবহৃত হয়। পাঞ্জাবে (ভারত ও পাকিস্তান) জাট, গুরজার ও রাজপুত গোত্রগুলো এই পদবী ব্যবহার করে। এছাড়া উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানেও এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়।
বাংলাদেশে চৌধুরী খেতাবধারী বিখ্যাত ব্যক্তিগণ হলেন, এ.কিউ.এম.বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আব্দুল মতিন চৌধুরী, আব্দুল বারী চৌধুরী,ফজলুল কাদের চৌধুরী, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী, চৌধুরী মঈনুদ্দিন, চৌধুরী খালিকুজ্জামান, নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী, প্রমথ চৌধুরী, মুনির চৌধুরী।
মজুমদার বংশের ইতিহাস : মজুমদার ( مجم دار) “মজুমদার” ফার্সী শব্দ। মৌজা শব্দের সাথে ফার্সী “দার” শব্দ যোগ হয়ে মজুমদার শব্দটি হয়েছে। যার অর্থ মৌজার অধিকর্তা। মোঘল ও ব্রিটিশ আমলে যারা এক বা একাধিক মৌজার অধিকর্তা ছিলেন তাদের মজুমদার বলা হতো তথা মৌজার ভূস্বামীরা ‘মজুমদার’ হিসেবে অভিহিত হতেন।
মজুমদার’ পদবী মূল আসলে মজুনদার’। এর মূল ফারসি শব্দ হচ্ছে মজমু আনদার’। রাষ্ট্রের ও জমিদারির দলিল পত্রাদির রক্ষক রাজকর্মচারীর জন্যে এই পদবী সংরক্ষিত ছিল। মজুমদার বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে মুসলিম এবং হিন্দুদের পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বৈদ্যরা “উপাধী” হিসেবেও “মজুমদার” ব্যবহার করে থাকেন।
পরবর্তী পর্ব : সৈয়দ বংশের ইতিহাস……
লেখক : মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন, শিক্ষক,লেখক,গবেষক, মানবাধিকার কর্মী ও গণমাধ্যম কর্মী