বাঙ্গালী মুসলমানের বংশ পদবীর সাতকাহন (৪র্থ পর্ব) [সৈয়দ বংশ ও মীর বংশ]
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:০২:০৪,অপরাহ্ন ১৩ আগস্ট ২০২০ | সংবাদটি ২১৮২ বার পঠিত
সৈয়দ বংশের প্রকৃত ইতিহাস
মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন : সৈয়দ পদবী মূলত এসেছে নবী নন্দিনী হজরত ফাতেমা(রাঃ) ও হজরত আলী (রঃ) এর বংশধর থেকে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের পবিত্র এই বংশের সঙ্গে কোন যোগসূত্র না থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক মুসলমান পরিবার নিজেদের নামের সাথে সৈয়দ বংশ পদবী ব্যবহার করে নিজেদের সম্ভ্রান্ত ও কুলীন মুসলমান বলে দাবি করে থাকেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে সৈয়দ পদবীর অপব্যবহার ও প্রক্ষেপণ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। প্রকৃত পক্ষে সৈয়দ নন এবং পারিবারিক কোনো কুলীন পদবীও নেই, অথবা পূর্ব পদবী ঐতিহ্য পরিত্যাগ করতে ইচ্ছুক এমন অনেক বংশ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষে বাংলাদেশে সৈয়দ পদবী আরোপিতভাবে ব্যবহার শুরু করেছিলেন এবং এখনো এ রোগ সমাজে চলমান আছে।
সৈয়দ বা সাইয়্যেদ বা সাইয়্যিদ (আরবি: سيد ; আরবি: سادة) হল এমন একটি সম্মানসূচক উপাধি যা দ্বারা নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা ও তার স্বামী আলী এবং তাদের সন্তান হযরত হাসান ও হোসাইনের বংশধারার মুহাম্মদ(সঃ) বংশধরগণকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। লেখ্যরূপের ক্ষেত্রে আরবী হরফ ছিন (আরবি: س) দ্বারা এ উপাধিটি লিখা হয় তাই এর বানান ছ- অক্ষর দিয়ে লেখা হয়ে থাকে। অন্যপক্ষে, যদিও সীন (আরবি: ش) মূল আরবী বানানে লেখা হয়না তথাপি স- অক্ষর যোগেও এ উপাধিটির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে হাসান ও হোসাইন উভয়ের বংশতালিকায় নবীর বংশধর বুঝাতে সৈয়দ এবং শরীফ উপাধিদ্বয় ব্যবহার করা হত। অন্যদিকে,পরবর্তী কালে হাসানি বংশ বুঝাতে পুরুষদের শরীফ ও নারীদের শরীফা এবং হোসাইনি বংশীয় বুঝাতে যথাক্রমে সৈয়দ ও সৈয়দা উপাধিতে ভূষিত করার রেওয়াজ লক্ষ্য করা যায়।
সৈয়দ হতে হলে পিতৃগোত্রজ হতে হবে এমন কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। মাতৃগোত্রজ ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এ উপাধি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৬৩২ সালে ওসমানী খেলাফত যুগে রাষ্ট্রীয় আদালত (ইংরেজি Ottoman Court) এক ব্যক্তিকে সৈয়দ উপাধিধারীদের ব্যবহার্য্য সবুজ পাগড়ী ব্যবহার করা বিষয়ে অভিযুক্ত করেন। আদালতে ঐ ব্যক্তি প্রমাণ করতে সফল হন যে, তিনি মাতৃগোত্রজ সূত্রে সৈয়দ এবং এ যুক্তিটি ছিল স্বীকৃত।
সৈয়দ রাজবংশ :
সৈয়দ রাজবংশ দিল্লি সালতানাতের চতুর্থ রাজবংশ। ১৪১৪ থেকে ১৪৫১ সাল পর্যন্ত এই রাজবংশ ক্ষমতায় ছিল। তুঘলক রাজবংশের পর তাঁরা দিল্লির ক্ষমতায় আসে। পরবর্তীতে লোদি রাজবংশের মাধ্যমে তাদের সমাপ্তি হয়। সৈয়দ রাজবংশ নিজেদের সৈয়দ বা নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর বংশধর বলে দাবি করত। তৈমুর লং এর আক্রমণের ফলে দিল্লি সালতানাতের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বিশৃংখলার পর যখন কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ছিল না তখন সৈয়দরা দিল্লির ক্ষমতা লাভ করে। ৩৭ বছরের শাসনে চারজন শাসক শাসন করেন।
সৈয়দ খিজির খান সৈয়দ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তৈমুর লং তাকে মুলতানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ১৪১৪ সালের ২৮ মে ‘সৈয়দ খিজির খান’ দৌলত খান লোদির কাছ থেকে দিল্লির শাসন ভার গ্রহণ করেন এবং সৈয়দ রাজবংশের সূচনা ঘটান। কিন্তু তিনি সুলতান উপাধি ধারণ করেননি বরং তৈমুরি রাজবংশের রায়াত-ই-আলা বা সামন্ত হিসেবে শাসন পরিচালনা করেন। ১৪২১ সালের ২০ মে খিজির খানের মৃত্যুরর পর তার পুত্র সৈয়দ মোবারক খান তার উত্তরাধিকারী হন। তিনি তার মুদ্রায় মুইজউদ্দিন মোবারক শাহ নাম মুদ্রণ করেন। ইয়াহিয়া বিন আহমদ সিরহিন্দির লেখা তারিখ ই মোবারক শাহি বইয়ে তার শাসনামলের বিবরণ রয়েছে। মোবারক শাহের মৃত্যুর পর তার ভাতিজা মুহাম্মদ খান ক্ষমতা লাভ করেন এবং সুলতান মুহাম্মদ শাহ হিসেবে নামধারণ করেন। তার মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার পুত্র সৈয়দ আলাউদ্দিন শাহ-কে বাদাউন থেকে ডেকে পাঠান এবং তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন। সৈয়দ রাজবংশের শেষ সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহ ১৯ এপ্রিল ১৪৫১ সালে স্বেচ্ছায় মুকুট ত্যাগ করেন। আর এর সাথেই সৈয়দ রাজবংশের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বাংলাদেশে সৈয়দ বংশের আগমন : সিলেট বিজেতা হযরত শাহজালাল (রঃ) এর অন্যতম সঙ্গী সিপাহ শালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিন যিনি হযরত আলী (রাঃ) এর ষোঢ়শ বংশধর ছিলেন। সিলেটের ইতিহাসের বহুল আলোচিত তরফরাজ্য ১৩০৪খৃষ্টাব্দে তারই নেতৃত্বে বিজয়ী হয়েছিল। সিলেট অভিযানে প্রেরিত মুসলি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি সিপাহশালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের জন্ম ১২৫০ খৃষ্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৩৪৬ খৃষ্টাব্দে। তরফের শাসন কর্তা অবস্থায় এই কীর্তিমান মহাপুরুষ ইহলোক ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র সৈংদ সিরাজ উদ্দিনের হাতে তরফের শাসনভার ন্যস্ত হয়। এই সৈয়দ সিরাজ উদ্দিন থেকেই সিপাহ শালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের বংশ বিস্তৃত হয়। পরবর্তীতে তার বংশে ওলী আওলিয়া, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ সহ অনেক গুণী ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে।
মুলক-উল -উলামা, আরাকান রাজ দরবারের সৈয়দ মুসা, বিখ্যাত সাধক সৈয়দ গদা হাসন, সৈয়দ শাহনুরী, মধ্যযুগের মহাকবি সৈয়দ সুলতান, লেখক ও গবেষক সৈয়দ মুজতবা আলী, ঐতিহাসিক সৈয়দ মোস্তফা আলী,সৈয়দ মুর্তাজা আলী ও সৈয়দ মোস্তফা কামাল তাদের মধ্যে অন্যতম।
পরিশেষে একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে,বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর উত্তর সূরী নবী নন্দিনী ফাতেমা (রা) ও হযরত আলী (রা) এর পরবর্তী বংশধরগণ ছাড়া অন্য কেউ সৈয়দ বংশ পদবী ব্যবহার করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে কেবলমাত্র হযরত আলী (রা) এর ষোড়শ বংশধর সিপাহশালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের বংশধরগনই এ বংশ পদবী ব্যবহারের অধিকার রাখেন । যদিও সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় এদেশে সৈয়দ পদবীর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্যনীয়।
মীর বংশের ইতিহাস
ভূমিকা : মির বা মীর শব্দটি এসেছে আরবি থেকে। আরবি শব্দ আমীর’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে মীর। সেই অর্থে মীর অর্থ দলপতি বা নেতা, প্রধান ব্যক্তি, সরদার ইত্যাদি। জিতে নেয়া বা জয়ী হওয়া অর্থে মীর শব্দের ব্যবহার হতো। তবে মীর বংশীয় লোককে সম্ভ্রান্ত এবং সৈয়দ বংশীয় পদবীধারীর একটি শাখা বলে গবেষকরা মনে করেন।
মীর (مير) একটি রাজকীয় পদবী বা রাজদত্ত পদবী যা পাক-ভারত উপমহাদেশের অনেক অঞ্চলে বা রাজ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইসলামিক প্রভাবের বিভিন্ন দেশ বা রাজ্যে এই পদবী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। হায়দ্রাবাদের নিজামদের পদবী ছিল মীর। মীর শব্দটিকে ফার্সি শব্দ “পীর” এর আরবি পরিভাষা হিসেবে অনুমান করা হয়ে থাকে। অনেকেই মীর শব্দটি আরবি আমীর শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে করেন। মুঘল সাম্রাজ্যে বিভিন্ন সামরিক শাখার প্রধানদেরকে মীর পদবী দেওয়া হতো।
মুঘল সাম্রাজ্যে মীর-ই মুন্সী, মীর-ই আতশ, মীর-ই মহল্লা, মীর-ই মঞ্জিল, মীর-ই শিকার, মীর-ই সামান, মীর বকশি প্রভৃতি পদে যারা চাকুরি করতেন তারা মূলত রাজকীয় সনদের মাধ্যমে পাওয়া রাজকীয় পদবী হিসেবে নামের পূর্বে “মীর” পদবী ব্যবহার করতেন। অনেক ক্ষেত্রে, ব্রিটিশ সরকার তাদের অনুগত মুসলমান জমিদার, নবাবদের রাজকীয় পদবী হিসেবে “মীর” পদবী দিয়েছেন। অনেক হিন্দুও এই পদবী পেয়েছেন কিন্তু তাদের নামের পূর্বে এই পদবী ব্যবহৃত হতে সচরাচর দেখা যায় না।
মুসলমান শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে কিছু শাসকের নামের পূর্বে “মীর” পদবী ব্যবহৃত হতো। এছাড়া সম্মানসূচক পদবী হিসেবেও অনেক সময় মীর পদবী ব্যবহার হতে দেখা যায় ।
বাংলাদেশের ফরিদপুর পদমদি নবাব এস্টেটের নবাবদের বংশপদবী হিসেবে সৈয়দ এবং রাজকীয় পদবী হিসেবে “মীর” পদবী ব্যবহার করা হতো। ভারতের হায়দারাবাদের নিজামদের রাজকীয় পদবী হিসেবে “মীর” পদবী ব্যবহৃত হতো। এছাড়া বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরবর্তী বৃটিশ আজ্ঞাবহ মুর্শিদাবাদের নবাব সৈয়দ মীর জাফর আলী খান এর গোত্র রাজকীয় পদবী হিসেবে “মীর” পদবী ব্যবহার করেছেন। মীর জাফরের পরবর্তী বংশধরগণ “মীর” পদবী ব্যবহারের পরিবর্তে “মীর জাদা” বা সংক্ষেপে “মির্জা” পদবী ব্যবহার করতো নামের শেষে। বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজ্যে “মীর” রাজকীয় পদবী হিসেবেই রাজকীয় সনদের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছিল মুঘল আমলে এবং পরবর্তীতে ইংরেজি শাসনামলে।
পরবর্তী পর্ব : তালুকদার বংশের ইতিহাস……
লেখক : মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন, শিক্ষক,লেখক,গবেষক, মানবাধিকার কর্মী ও গণমাধ্যম কর্মী