ঊষারবাণী ডেস্ক : হেফাজতে ইসলামের মূল ঘাঁটি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতেই এখন বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে সংগঠনটি। কয়েক মাসের ব্যবধানে দুই ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে নেতাদের মসনদ।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মৃত্যুর আগে হেফাজতের আমির আহমদ শফীর সঙ্গে মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আনে সংগঠনটির বিরোধকে। আর যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ড ধাক্কা দিয়েছে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক ভিত্তিকে। তবে হেফাজতের এভাবে ভেঙে পড়ার নেপথ্যে আরও একাধিক কারণ দেখছেন সমাজ ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুপম সেন বলেন, ‘পদ নিয়ে শীর্ষ দুই নেতার বিরোধ হেফাজতের সাংগঠনিক কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। আর যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ড নষ্ট করে দেয় সংগঠনটির মনোবল। নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু নেতার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ রয়েছে। এসব কারণে এই সংগঠনটির প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কমছে প্রতিদিন।’

হেফাজতের এ বিপর্যয়ের পেছনে আরও দুটি কারণ দেখছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে কখনোই বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি হেফাজতের মূল নেতৃত্ব; বরং নারী শিক্ষা ও সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করেছে হেফাজতে ইসলাম। আয়-ব্যয় নিয়েও তাদের নিজেদের মধ্যে আছে অবিশ্বাস ও সন্দেহ। এই দুর্বলতাগুলো ছিল তাদের জন্ম থেকেই। কিন্তু হঠাৎ করে তারা যখন নিজেদের বড় ভাবতে থাকল, তখন সামনে আসতে থাকল তাদের দুর্বলতাগুলোও।’

দুই ঝড়ে যেভাবে টালমাটাল হেফাজত :হেফাজতে ‘প্রথম ঝড়’ আসে গত বছরের জুনে। ২০২০ সালের ১৭ জুন তখনকার আমির আহমদ শফীর সঙ্গে মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। এই দিন আহমদ শফীর সভাপতিত্বে দারুল উলুম মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত হয় শূরা কমিটির এক বৈঠক। এতে হাটহাজারীর দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বাবুনগরীকে। এ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয় মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা শেখ আহমদকে। বাবুনগরীর হেফাজতের আমির হওয়ার পথ রুদ্ধ করতেই শেখ আহমদকে দায়িত্ব দেন আহমদ শফী। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আসে হেফাজতের ভাঙন। এতে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায় হেফাজত। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে কথাও বলতে শুরু করেন প্রকাশ্যে। মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডও বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেনি সংগঠনটি। মামুনুলকে বিশ্বাস করে তার ফাঁদেই পা দিয়েছে। এ কারণে সরকারও হেফাজতকে চাপ দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে। সেই চাপ সামলাতে না পেরে এবার কমিটিই বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হয়েছে বাবুনগরীকে। এ ঘোষণা হেফাজত নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে দারুণভাবে। এটি জোড়া লাগাতে রোববার রাতে নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেখানেও ছিল না দূরদর্শিতা। মধ্যরাতে প্রথমে তিন সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে সংগঠনটি। এর কিছুক্ষণ পর আবার তিন সদস্যের কমিটিকে পাঁচ সদস্যে রূপান্তর করে দলটি।

ঐক্যে ফাটল ধরার নেপথ্যে :জানা গেছে, আহমদ শফীর অবর্তমানে হেফাজতের আমির পদে আগ্রহী প্রার্থী ছিল কয়েকজন। মজলিসে শূরার একটি অংশ আমির হিসেবে দেখতে চায় আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীকে। আরেকটি অংশের পছন্দ ছিলেন জুনায়েদ বাবুনগরী। আবার আরেকটি পক্ষ আমির হিসেবে চায় দলের প্রভাবশালী নায়েবে আমির মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীকে। এ তিন পক্ষের মধ্যে আনাস মাদানীর অংশের সখ্য ছিল সরকারের সঙ্গে। বাবুনগরীর অনুসারীরা সখ্য গড়েছে বিএনপির সঙ্গে। আর মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর সম্পর্ক ভালো ছিল জামায়াতের সঙ্গে। হেফাজত নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও নানা কারণে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। তাই সংগঠনের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি কে হচ্ছেন, তা নিয়েও তৈরি হয় দ্বন্দ্ব।

হাটহাজারীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রণপ্রস্তুতি :হেফাজতের কমিটি বিলুপ্তির আগে রোববার রাতেই হাটহাজারী থানা এলাকায় বিপুলসংখ্যক র‌্যাব, বিজিবি ও পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্সের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। পার্বতী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, হাটহাজারী সরকারি কলেজ, হাটহাজারী উপজেলা কম্পাউন্ড, হাটহাজারী থানার সম্মুখের অডিটোরিয়াম ও বাসস্টেশন এলাকায় অবস্থান নেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য।

গ্রেপ্তার আতঙ্কে আগেই আত্মগোপনে চলে গেছেন হেফাজত নেতাকর্মীরা। গত শনিবার মেখল মাদ্রাসায় হেফাজতের প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমানকে আটক করতে পুলিশ ও র‌্যাব অভিযান চালানোর পর থেকে চরম আতঙ্কে রয়েছে হেফাজত নেতাকর্মীরা। রোববার থেকে বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হাটহাজারীতে অবস্থান করায় প্রকাশ্যে হেফাজত নেতাকর্মীদের দেখা নেই বললেই চলে। তবে হেফাজতের উপজেলা পর্যায়ের সিনিয়র নেতারা হাটহাজারী মাদ্রাসায় আত্মগোপনে রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।