যে কারণে সিলেটে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৫৮:৪৭,অপরাহ্ন ৩১ মে ২০২১ | সংবাদটি ৩৭৩ বার পঠিত
সিলেট ব্যুরো : ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে খ্যাত সিলেটের ডাউকি ফল্টে ২০২০ সালের জানুয়ারি এবং এপ্রিল মাসে যে ভূমিকম্প হয়, এর উৎপত্তিস্থল ছিলো সিলেটের উত্তর-পূর্ব গোয়াইনঘাট এলাকায়। আর গত শনি ও রবিবার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল একই এলাকার সিলেট নগরী ও জৈন্তাপুর এলাকায়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পের এই ‘ডেঞ্জার জোন’ সিলেট থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী ডাউকি ফল্টের (ফল্ট হচ্ছে ভূগর্ভস্থ প্লেটের ফাঁক) অবস্থান। অন্যদিকে, শাহবাজপুর ফল্টও (হবিগঞ্জ-কুমিল্লা এলাকাধীন) সিলেটের কাছাকাছি। যে কারণে সিলেটের জন্য ভূমিকম্পের ঝুঁকি খুবই বেশি।
সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘সর্বশেষ সিলেটের শ্রীমঙ্গলে উৎপত্তিস্থল হিসেবে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই রিখটার স্কেলে ৭.৬ মাত্রার ভূকম্পন হয়।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পন প্রবণ এলাকায় ১শ বছর পর পর বেশি মাত্রার ভূকম্পন হয়ে থাকে। ডাউকি ফল্টে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে সিলেট অঞ্চলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হতে পারে বলে আশঙ্কা এ আবহাওয়াবিদের।
তিনি জানান, এ অঞ্চলে সাধারণত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ও মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে ভূকম্পন হয়ে থাকে। সর্বশেষ ১৯১৮ সালে উৎপত্তিস্থল হিসেবে সিলেট অঞ্চলে ভূকম্পন অনুভূত হয়। ৭.৬ রিখটার স্কেল মাত্রার এ ভূকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিলো বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায়। প্রায় শতাধিক বছর পর এ বছর দেড় মাসের মধ্যে এই দুইবার সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার মধ্যবর্তী স্থান থেকে ভূকম্পনের উৎপত্তি হয়েছে। আর শনি ও রবিবার কয়েক দফা অনুভূত হলো সিলেট নগরী এলাকায়।
তিনি জানান, শ্রীমঙ্গল ইস্টার্ন ফল্টের সাইড লাইনে অবস্থিত। আর গোয়াইনঘাট অবস্থিত ডাউকি ফল্টে।
আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ডাউকি ফল্ট হচ্ছে বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব কোণের সিলেট অঞ্চলে। কিন্তু, এই ফল্টের অবস্থান সিলেট জেলার সীমান্ত উপজেলা গোয়াইনঘাট ছাড়িয়ে ভারতের ভেতরে।’
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের তিনটি বলয় বা জোন চিহ্নিত করা হয়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জোন উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সর্বাপেক্ষা কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত। সিলেট উত্তর-পূর্বাঞ্চল জোনে থাকায় এখানে ভূমিকম্পের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর্থ অবজারভেটরির গবেষক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার তার গবেষণা মডেলে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের দুই দিকের ভূগঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। এর একটা হচ্ছে উত্তরপূর্ব কোণে সিলেট অঞ্চলের ডাউকি ফল্টে, আরেকটা হচ্ছে পূর্বে চিটাগাং ত্রিপুরা বেল্টের পাহাড়ি অঞ্চলে। এখানে দুটি বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে বলে জানান এ বিশেষজ্ঞ।
সূত্র মতে, ১৫৪৮ সালে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সিলেট এলাকায় ব্যাপক ভূপরিবর্তন ঘটে। উঁচু-নিচু ভূমি সমতলে পরিণত হয়। এরপর ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৮১২ ও ১৮৬৯ সালের ভূমিকম্পে সিলেটের মানচিত্র অনেকটাই পাল্টে যায়। সিলেটে এ যাবৎকালের মধ্যে ১৮৯৭ সালের ১২ জুন বিকাল সোয়া ৫টার দিকে সংঘটিত ভূকম্পন গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক নামে পরিচিত। ৮ দশমিক ৭ মাত্রার সেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার পাকা দালানকোঠার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। শুধু সিলেট জেলারই ৫৪৫টি ভবন ভেঙে পড়ে। মারা যায় অনেক মানুষ। ঐ ভূমিকম্পের ফলেই সিলেট জুড়ে সৃষ্টি হয় বিশালাকারের হাওর, বিল ও জলাশয়।
সাঈদ আহমেদ বলেন, ‘প্রায় ১০০ বছর পর সিলেটে যে তিনটি বড় ভূকম্পন হয়েছে, সেটাকে বিপদ সংকেত হিসেবে ধরে নিতে হবে।’