ঐ সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, চারটি সেক্টরের দুর্নীতি অনুসন্ধানে তিনি অভিযুক্তদের আপসের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে কমিশনে মামলার সুপারিশ করেন। এজন্য তাকে সরাসরি চাকরিচ্যুতির হুমকি দেয় প্রভাবশালী চক্র।
তিনি মনে করেন, তাকে নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিতে অভিযুক্ত চক্রগুলো একযোগে সর্বশক্তি নিয়ে তত্পরতা চালিয়েছে। দুর্নীতির তদন্তে অভিযুক্তদের সুপারিশেই তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো। অভিযুক্তদের যেসব সেক্টরের দুর্নীতি অনুসন্ধান করে মামলার সুপারিশ করেছিলেন সেগুলো হচ্ছে :কক্সবাজারের ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত দুর্নীতি, কক্সবাজার-বান্দরবানের রোহিঙ্গা স্পেশাল জোনে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য জাল কাগজপত্র, পাসপোর্ট তৈরিতে অংশ নেওয়া কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি, পেট্রোবাংলার প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের বেশকিছু অনিয়ম যথা জমিক্রয়ে দুর্নীতি, মধ্যরাতে নিয়োগ ও পদোন্নতি ও অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রদান এবং সর্বশেষ চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতে বিশৃঙ্খলা, সিন্ডিকেট করে মাফিয়াদের দুর্নীতির তত্পরতা।
জানা যায়, শরীফ উদ্দিন তার অনুসন্ধানে বিভিন্ন দুর্নীতির বিষয় উদঘাটন করে কমিশনের সম্মতিতে কমিশন বরাবর মোট ২২টি মামলার সুপারিশ করেছিলেন। অন্যদিকে অভিযুক্ত চক্র ও দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটগুলো তাকে বেকায়দায় ফেলতে তার বিরুদ্ধে বেশকিছু বিভিন্ন ধরনের অভিযোগও নামে-বেনামে কমিশন বরাবরে পেশ করে। এমনকি এই পরিস্হিতির ধারাবাহিকতায় তার বিরুদ্ধে তিনটি বিভাগীয় মামলা ও কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি হয়। পরিস্থিতি প্রচণ্ড প্রতিকূল হয়ে উঠায় তাকে ঐ চক্রগুলো গুম করতে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা করেন। তার বিরুদ্ধে যে তিনটি মামলা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে— তিনি যাতে আসামিদের টাকা সরাতে না পারেন সেজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ব্যবস্থাপক বরাবরে নোটিশ, করোনায় আক্রান্ত থাকাকালে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি হওয়ার পর কর্মস্হলে যোগদান এবং মামলার নথি বুঝিয়ে না দেওয়া।
শরীফ উদ্দীন ইত্তেফাককে জানান, কমিশন থেকে তার বিরুদ্ধে আরো যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তিনি সেসব অভিযোগের জবাব তৈরি করেছেন। এটি তিনি গণমাধ্যমকে জানাতে চান।
শরীফ উদ্দিন জানান, ২০২০ সালের ১৮ ফেব্র‚য়ারি একটি সংস্থা ও র্যাব কক্সবাজারে চাঞ্চল্যকর ভূমি দুর্নীতির বিষয়টি উদ্ঘাটনে দুই জন সার্ভেয়ারের বাসায় অভিযান চালিয়ে ১ কোটি নগদ টাকা এবং সাত বস্তা আলামত উদ্ধার করেছিল। এ বিষয়ে কমিশন আমাকে মামলা করার অনুমতি দেন। আমি ১৯ মার্চ কক্সবাজার এলএ বিভাগ এবং থানা থেকে আলামত চট্টগ্রামে নিয়ে আসি। এতে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলে ১৪ ব্যক্তির। যার সঙ্গে এলএ শাখার দালালরাও যুক্ত। এর মধ্যে পাঁচ জনকে আটক করে আমি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করতে সক্ষম হই। তদন্ত প্রায় শেষ করে আনি। এই অনুসন্ধানে ৫০ কোটি টাকা জব্দ করে সরকারি খাতে জমা দেওয়ার ব্যবস্হা করি। অনুসন্ধানে দুর্নীতির সঙ্গে টাউট, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, আইনজীবীসহ আরো অনেক ব্যক্তি জড়িত থাকার প্রমাণ মিলে। এই অনুসন্ধানে ২০২১ সালের ৩০ জুন কমিশন বরাবর তিনটি রিপোর্ট প্রদান করি। এতে ১৫৫ জনকে আসামি করা হয়। মূলত সেই রিপোর্টের সূত্র ধরে সুবিধাভোগী ও আমলাতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আমাকে স্রোতের অনুকূলে চলার জন্য বলে। কিন্তু আমি এই সত্য রিপোর্টগুলো কমিশনের সাহাজ্য নিয়ে দাখিল করি।
তিনি বলেন, কক্সবাজারে চাঞ্চল্যকর ২য় অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে কীভাবে এক শ্রেণির জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে রোহিঙ্গারা জাল কাগজপত্র বের করে নাগরিকত্ব পাচ্ছে। এসব ঘটনায় বেশকিছু মামলা হয়। ২০২১ সালের কক্সবাজারের ঈদগাওয়ে ইসলামাবাদ ইউনিয়নকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের তত্পরতায় ১০ রোহিঙ্গার পাসপোর্ট গ্রহণ এবং বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট অর্জনের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। সেখানে তদন্তে দেখা যায়, এসব রোহিঙ্গার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিদের যোগসাজশ রয়েছে। অবশ্য বিষয়টি উদ্ঘাটিত হওয়ার পর তাদের সার্টিফিকেট পাসপোর্ট বাতিল হয়। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে। আমার অনুসন্ধানে ক্ষুব্ধ হয়ে গত এক বছর আগে থেকে এসব ব্যক্তি ফেসবুকে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে।
৩য় অনুসন্ধানে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের বিভিন্ন দুর্নীতির বিষয় উদ্ঘাটন করে ১০টিরও বেশি মামলার সুপারিশ করেছিলাম কমিশন বরাবরে। এর মধ্যে মাত্র একটি মামলা রুজু হয় এবং তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করি। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের এক জন প্রভাবশালী ব্যক্তিও আসামি হয়। মামলার পরদিন কর্ণফুলী গ্যাসে অভিযান চালিয়ে নগরীতে দেওয়া অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে এ অনিয়মের প্রতিকার করে।
চতুর্থ বিষয়টি হচ্ছে করোনা চলাকালীন দেখা যায় যে, চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাত অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পড়েছে। আমি চট্টগ্রামের স্বাস্হ্য খাতে জড়িত দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে কমিশন বরাবরে মামলার সুপারিশ পেশ করি। এই পরিস্হিতিতে গত ৩০ জুন আমার চট্টগ্রাম নগরীস্থ বাসায় পেট্রোবাংলায় কর্মরত পরিচালক (পরিকল্পনা) পদের একজন কর্মকর্তা তার সঙ্গে কর্ণফুলী গ্যাসের সহকারী প্রকৌশলী পদবির এক কর্মকর্তাকে নিয়ে চড়াও হয়। তারা আমাকে হুমকি দেওয়ার জন্য সেখানে আরো ২০ থেকে ২৫ জন সন্ত্রাসীকে জড়ো করে। তারা বলতে থাকে যে, আমার জন্য কক্সবাজারের মেয়র চট্টগ্রামের বিএমএর একজন নেতা এবং সরকারের একজন উপ-সচিবের জীবন বরবাদ হয়ে গেছে। ঐ ব্যক্তি আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়ে চলে যায়। আমি দেখলাম, এক সপ্তাহ নয়, ১৫ দিনের মাথায় আমার চাকরিচ্যুতির চিঠি আসে।
শরীফ উদ্দিন ইত্তেফাককে এক ইমেইল বার্তায় বলেন, কমিশন বরাবরে যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তারা সবাই আমার অনুসন্ধান/মামলায় সংশ্লিষ্ট। তাদের কতৃর্ক দাখিলকৃত অভিযোগসমূহ কমিশন আমলে নিয়েই আমার দাখিলকৃত জবাব যাচাইবাছাই না করেই অভিযোগ প্রমাণের আগেই কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়াই, বিবেচনাধীন মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন থাকাবস্হায়ই চাকরি হতে অপসারণ করেন, এটা সাংবিধানিক অধিকার হতে বঞ্চিত করা হলো।