হাকালুকি হাওরে দু’দফা বিপজ্জনক টর্নেডো ও জলস্তম্ভ,আবারো ঘটার শঙ্কা
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:০৬:৩১,অপরাহ্ন ২৭ জুলাই ২০২২ | সংবাদটি ৩৪৮ বার পঠিত
মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার : এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকিতে চলতি সপ্তাহে পরপর দুদিন waterspout বা জলজ টর্নেডো সৃষ্টি হয়েছে যা হাকালুকি তীরের লোকেদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য সিলেটের ৬টিঁ উপজেলা, কুলাউড়া,জুড়ী, বড়লেখা,বিয়ানী বাজার, গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা মিলে ১৮১.১৫ বর্গ কি.মি.এলাকা জুড়ে হাকালুকি হাওর বিস্তৃত।
গত ২৩ জুলাই (শনিবার) হাকালুকি হাওরের বড়লেখা উপজেলার অংশে চাতলাবিল এলাকায় বিস্ময়কর এ টর্নেডোর সৃষ্টি হয়। যা হাকালুকি এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও কৌতুহল সৃষ্টি করে।। অনেকেই এ ঘটনা ভিডিওচিত্র ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেন। পরদিন রোববার (২৪ জুলাই) বিকেল সোয়া ৪টার দিকে হাকালুকি হাওরের জুড়ি উপজেলা এলাকায় দ্বিতীয়বার অনুরূপ টর্নেডোর দেখা মেলে।
টর্নেডোর উৎপত্তির বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রোববার বিকেলে জাপানের কাইটো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের প্রফেসর ড. শি থাইচি হায়াসি ও মাসাশি সাকামতো এবং আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী হাকালুকি হাওর পরিদর্শনে করেন। সেসময় তারা দেখতে পান আবারো টর্নেডোর সৃষ্টি হয়েছে। তবে এর পানির স্তম্ভ আগের দিনের টর্নেডোতে সৃষ্ঠ স্তম্ভের চেয়ে অধিকতর দুর্বল ছিল সেটি। তবে তাদের ধারনা হাকালুকি এলাকায় এরকম টর্নেডো আরো ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, জাপানের দু’জন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নিয়ে হাকালুকি হাওরে টনের্ডোস্থল পরিদর্শনে গেলে ওইদিন আবারো টর্নেডোর উৎপত্তি চোখে পড়ে। অবশ্য সেটি দুর্বল ছিল। আমরা অনেকটা দূর থেকে টর্নেডোস্থল দেখেছি। সেখানে বাতাসের ইউং ছিল কম। ভ্যাপসা গরম ছিল এবং বাতাসের ঘুর্ণয়ন গতি যে পানি উপরে টেনে তোলে আবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে যায়।
বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, শুধুমাত্র জলভাগে টর্নেডোর তেমন ক্ষতি করতে পারে না। তবে এর ব্যপ্তি ১৫/২০ কিলোমিটার হতে পারে। এটির ঘুর্ণায়ন গতিসীমায় যা পড়বে, তা উপরে তুলে নেবে। এ সময় আকাশে কালো মেঘ জমে বিজলী চমকায় এবং বিকট শব্দে গর্জন হয়। তবে লম্বা পিলার আকারের (ডধঃবৎংঢ়ড়ঁঃ) স্তম্ভের নীচের মাটি -পানির সংস্পর্শে থাকলে সেটি প্রলয়ঙ্করী রূপ ধারণ করে। সাধারণত এ জাতীয় টর্নেডোর গতিসীমা ২০০ কিলোমিটার বা তারও অধিক হতে পারে। এর আগে নেত্রকোনায়ও এ রকম টর্নেডোর সৃষ্টি হয়েছিল। সেটির ব্যপ্তি ছিল ১২ কিলোমিটার জুড়ে।
এদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান হাকালুকির টর্নেডোর বিষয়ে গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এটি অবশ্যই একটি শক্তিশালী টর্নেডো ছিল। আমরা সাধারণত স্থলভাগে টর্নেডোর কথা শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু আমাদের জলাভূমিগুলোয় এ ধরনের টর্নেডো আঘাত হেনে থাকে। দেশের উপকূলীয় এলাকা, বঙ্গোপসাগর ও জলাভূমিগুলোয় প্রতিবছরই ছোট ছোট টর্নেডো আঘাত হানার তথ্য আমরা পাই। তবে অন্য টর্নেডোর তুলনায় হাকালুকির টর্নেডোটি বেশ ব্যতিক্রম ছিল। এর ফানেলটির দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ৫০০ মিটার বা আধা কিলোমিটার বলে মনে হয়েছে।
আব্দুল মান্নান আরও বলেন, এমনিতেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাব আমরা বাংলাদেশে দেখতে পাচ্ছি। গত জুন মাসে আমরা ভারতের চেরাপুঞ্জিতে এক দিনে প্রায় এক হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরেও অনেক স্থানে অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া ভরা বর্ষা মৌসুমে টানা দাবদাহ। সবগুলাই আবহাওয়ায় অস্বাভাবিক ঘটনা। টর্নেডোও অস্বাভাবিকতার আরো একটি উদাহরণ। অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে সিলেটের হাওর এলাকাগুলোয় জলীয় বাষ্প দ্রæত ওপরের দিকে উঠে গিয়ে শূন্যতা তৈরি হয়। আর আকাশে মেঘ থাকায় প্রচুর জলীয় বাষ্প নিয়ে টর্নেডোটি আঘাত হানে।
এটি ভূমিতে আঘাত করলে কী হতে পারত এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল মান্নান বলেন, এটি ভূমিতে আঘাত হানলে জীবন ও সম্পদের বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় ১৯৮৯ সালে ২৬ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়ংকর টর্নেডো আঘাত হানে। সেখানে হাজারখানেক মানুষ প্রাণ হারায়। লাখখানেক মানুষের বাড়িঘর ধ্বংস হয়।এরপর আমরা ২০১৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ২০১৪ সালে নেত্রকোনায় টর্নেডো আঘাত হেনেছিল। এ কারণে ভূমিতে আঘাত হানলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হতো।
তিনি বলেন, গত এক যুগে দেশে টর্নেডোর আঘাত হানার প্রবণতা বেড়েছে। আগে সাধারণত আমরা ৪ থেকে ৫ বছর পরপর টর্নেডো আঘাত হানতে দেখেছি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো টর্নেডো আঘাত হানছে। এতে স্থানীয়ভাবে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে জলজ টর্নেডোর পরিমাণ বেড়ে যেতে দেখছি। আর টর্নেডোর পূর্বাভাস এখনো সঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে আমাদের টর্নেডোর ক্ষতি মোকাবিলার উপযোগী করে বাড়িঘর নির্মাণ করতে হবে। কোথাও টর্নেডো সৃষ্টি হলে পাকা ভবন ও শক্তিশালী কোনো অবকাঠামোর মধ্যে আশ্রয় নিতে হবে।
উল্লেখ্য, শনিবার বিকেলে হাকালুকি হাওরের বড়লেখা উপজেলা অংশের চাতলাবিল এলাকায় বিস্ময়কর টর্নেডোর দেখা মেলে। ওই সময় হাকালুকির পানি জোয়ারের ন্যায় জলস্তম্ভটি টেনে আকাশে তুলে। আকাশ কালচে বর্ণ ধারণ করে বিজলী চমকে গর্জন করতে থাকে। জল আর আকাশে পানির পিলারের তৈরী হওয়া স্তম্ভ দেখতে হাকালুকির তীরবর্তী লোকজন কৌতুহল ভরে দেখতে থাকেন। সেটি বেশ কিছুক্ষণ স্থায়ী ছিল। তখন আকাশ কালো মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। হাওরে নৌকা নিয়ে থাকা অনেকে সেটি দেখে ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে তীরে চলে আসেন।