শিরোনাম

পাকিস্তানে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত : নিউইয়র্ক টাইমস

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৩ সপ্তাহ আগে
ছবি : সংগৃহীত

কাশ্মিরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে করে সামরিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরিস্থিতি শান্ত করতে আহ্বান জানিয়েছে, তথাপি ভারত এখন উত্তেজনা কমানোর বদলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস।

রবিবার (২৭ এপ্রিল) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের একাধিক দেশের নেতাদের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি দিল্লিতে অবস্থিত শতাধিক কূটনৈতিক মিশনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়মিত বৈঠক করছে। তবে এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক সহায়তা চাওয়া নয়, বরং পাকিস্তানে সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের যৌক্তিকতা তুলে ধরা — এমনটাই জানিয়েছেন চারজন কূটনীতিক।

গত বৃহস্পতিবার মোদি এক ভাষণে পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করলেও “সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ধ্বংস” ও “কঠোর শাস্তির” ইঙ্গিত দেন। এরই মধ্যে ভারতীয় সীমান্তে কয়েক রাত ধরে ছোট অস্ত্রের গুলিবিনিময়ের ঘটনাও ঘটেছে। নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মিরজুড়ে ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে এবং শত শত ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।

ভারত এর আগে পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত নদীগুলোর পানি আটকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং দিল্লিতে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের কিছু কর্মী ও ভিসাধারী পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশত্যাগের নির্দেশ দেয়। প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলওসি) যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে।

এছাড়া ভারতের অভ্যন্তরে মুসলিম ও কাশ্মিরি শিক্ষার্থীদের ওপর বৈষম্য এবং হয়রানির ঘটনা বেড়েছে। অনেক কাশ্মিরি শিক্ষার্থী বাধ্য হয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন।

তবে হামলার পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও ভারত সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নাম প্রকাশ করেনি বা পাকিস্তানের জড়িত থাকার পক্ষে শক্ত প্রমাণ তুলে ধরেনি। অন্যদিকে ইসলামাবাদ এই হামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছে।

কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে ভারতীয় কর্মকর্তারা পাকিস্তানের অতীতের সন্ত্রাসবাদে সহায়তার নানা উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় হামলাকারীদের সঙ্গে পাকিস্তানের সংযোগের কিছু প্রযুক্তিগত প্রমাণ পাওয়া গেছে, তবে এখনও সে সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

বিশ্লেষকদের মতে, শক্ত প্রমাণের অভাব দুইটি বিষয় ইঙ্গিত করে: হয়তো ভারত এখনও প্রমাণ সংগ্রহ করছে, অথবা তারা মনে করছে— বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছাড়াই তারা নিজেদের পক্ষে পদক্ষেপ নিতে পারবে।

উল্লেখ্য, উভয় দেশই পরমাণু অস্ত্রধারী হওয়ায় সামান্য উত্তেজনাও ভয়াবহ সংঘাতে রূপ নিতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির কারণে আন্তর্জাতিক চাপের প্রতি তাদের আগ্রহ কমে গেছে।

এই সংকটের মধ্যেই ইরান ও সৌদি আরব মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে, আর জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংযমের আহ্বান জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় শক্তিগুলো বর্তমানে অন্য সংকট নিয়ে ব্যস্ত থাকায়, ভারত অনেক দেশ থেকে কার্যত মৌন সমর্থন পাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয় দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বললেও ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাদের দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কতটা সক্রিয় হবে, তা এখনও অনিশ্চিত। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে ভারতে এখনও কোনো মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া হয়নি, যা দক্ষিণ এশিয়াকে তাদের অগ্রাধিকার তালিকার নিচে থাকার ইঙ্গিত দেয়।

বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য দেশ যদি মধ্যস্থতা করতেও চায়, তবুও তাদের প্রভাব সীমিত হতে পারে। কারণ ভারত ও পাকিস্তান অতীতেও কাশ্মির নিয়ে একাধিক যুদ্ধ করেছে এবং উভয় দেশই পুরো কাশ্মির নিজেদের দাবি করে।

২০১৯ সালের কাশ্মির সংকটের সময় যেমন ঘটেছিল, এবারও ভারতের প্রাথমিক কূটনৈতিক কৌশল একই রকম। তখন জইশ-ই-মুহাম্মদ গোষ্ঠীর সরাসরি সম্পৃক্ততা নিশ্চিত ছিল। ভারত তখন পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল এবং পরে পাকিস্তান প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়ে একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার ভারত আরও বড় ধরনের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করছে। পাকিস্তানও পাল্টা জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং ঘোষণা দিয়েছে— যদি ভারত হামলা চালায়, তারা আরও বড় পাল্টা আঘাত হানবে।

বিশ্লেষক ড্যানিয়েল মার্কি সতর্ক করে বলেছেন, উভয় পক্ষই নিজেদের সক্ষমতা অতিরঞ্জিতভাবে দেখাচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে।

এছাড়া এবারের হামলার ক্ষেত্রে হামলাকারী গোষ্ঠী ও সদস্যসংখ্যা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। “রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট” নামে একটি অপেক্ষাকৃত অপরিচিত সংগঠন হামলার দায় স্বীকার করলেও ভারতীয় কর্মকর্তারা মনে করেন এটি পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার ছায়া সংগঠন।

ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শঙ্কর মেনন বলেন, ২০১৬ ও ২০১৯ সালের মতো এবারও ভারতের জন্য পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালানো ছাড়া খুব বেশি বিকল্প নেই। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, পরিস্থিতি সীমিত সংঘাতের মধ্যেই থাকবে, কারণ দুই পক্ষই নিয়ন্ত্রিত উত্তেজনা বজায় রাখতে আগ্রহী।

সবশেষে বলা যায়, ভারত এখনো দৃঢ় প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানের অতীতের রেকর্ডের ওপর নির্ভর করে সামরিক পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এক কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন, “কেবল অতীতের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীর সঙ্গে কি যুদ্ধ শুরু করা উচিত?”