পশ্চিমাদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য ধরে রেখেছে ইরান। আর এর পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ইব্রাহিম রাইসির। নানা কূটকৌশলের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রাখতে দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা। তার আকস্মিক মৃত্যুতে প্রশ্ন উঠেছে, তবে এ অঞ্চলে কী প্রভাব অব্যাহত থাকবে? আর তার মৃত্যুতে কতটা চাপে পড়ল তেহরান?
মার্কিনকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইরানকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছানো এক প্রতাপের নাম ইব্রাহিম রাইসি। তার নেতৃত্বে যখন বিশ্বপরিস্থিতি আমূল পাল্টে দেয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি করছে তেহরান, তখনই আকস্মিক মৃত্যু হলো ইরানি প্রেসিডেন্টের। এতে তার মৃত্যুর পর উঠেছে নানা প্রশ্ন।
মূলত ইরানকে পঙ্গু করতে নিষেধাজ্ঞার খেলায় মেতে আছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা জোট। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নিষেধাজ্ঞার ভেতরেই বসবাস করছে তেহরান। তবে পশ্চিমাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিধর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তেহরান।
শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন ধরেই ইসরাইলের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক দেশটির। তেহরানকে দমাতে কম ফন্দি আঁটেনি তেলআবিবও। বিশেষ করে ইরানি ভূখণ্ডে সাম্প্রতিক হামলা তারই প্রমাণ। বছরের পর বছর ধরে, রাইসি সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
তবে মুখোমুখি সংঘাত এড়িয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে দাপট দেখিয়ে তা ভিন্ন কৌশলে মোকাবিলা করেন ইব্রাহিম রাইসি।
২০২১ সালে ইব্রাহিম রাইসি ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় প্রতিবেশীদের পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছিলেন। ইরানের এই কূটকৌশলের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পাওয়ার। ক্রমবর্ধমান প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ শক্তির বাইরে আঞ্চলিক বলয় তৈরি করেছে ইরান।
বিশেষ করে চলমান গাজা সংঘাতকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস, লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ইরানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে চলেছে।
একইসঙ্গে বিবেচনা করলে, ইরান স্পষ্টতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নাস্তানাবুদ করতে বিরাট প্রভাব বলয় তৈরি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের ক্রান্তিকালে এসেও ইরানের চালকের আসনে বসার নেতৃত্ব মেলে রাইসির।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব ব্যাপক এবং বহুমুখী। বিশ্বে সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়া, চীনের পাশাপাশি উঠে এসেছে ভারত, উত্তর কোরিয়া ও ইরান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরানের মতো সমকক্ষ শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই।
ইরান সামরিক শক্তির পাশাপাশি অর্থনীতিতেও অন্যতম বড় নিয়ামক। ইরানের অর্থনীতিতে তেল এবং গ্যাসের রফতানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাণিজ্য মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের প্রায় ৫০ ভাগ বাণিজ্য হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে। যুদ্ধের ফলে ইরান এ প্রণালি বন্ধ করে দিলে তার নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বের পাশাপাশি মার্কিন অর্থনীতিতেও পড়বে।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরানো, আঞ্চলিক প্রাধান্য বজায় রাখা এবং চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে মূল্যবান জোটগুলোকে শক্তিশালী করা সবটাই করেছে ইরান।
ইরান, চীন ও রাশিয়া কেন্দ্রিক মধ্যপ্রাচ্যে যে বলয় সৃষ্টি হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে তা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে কাজ করছে ইরান।
তাই রাইসির মৃত্যুতে ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।