জলবায়ু সংকট যখন মানব সভ্যতার ধ্বংসের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন এটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার জন্য বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেছেন, মানব সভ্যতা বাঁচিয়ে রাখতে হলে একটি নতুন জীবনধারা গ্রহণ করতে হবে এবং একটি নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তার দীর্ঘদিনের লালিত “থ্রি জিরো” বা “তিন শূন্য” ধারণা বাস্তবায়নের মাধ্যমে।
বুধবার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৯) চলাকালে সংকট মোকাবেলার সমাধান হিসেবে তিনি বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেন এই তিন শূন্যের ধারণা।
ইউনূস তরুণদের উদ্দেশে আহ্বান জানান, তারা যেন তিন শূন্যের আদর্শে গড়ে ওঠে এবং জীবনব্যাপী এই আদর্শে অটল থাকে।
কপ-২৯ সম্মেলন মঙ্গলবার শুরু হয় এবং আগের সম্মেলনগুলোতে দেয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নিয়েই আলোচনা চলছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। এর জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমাতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অভিযোজনের জন্য সাহায্য করতে, উন্নত দেশগুলো বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। তবে, সেই প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন এখনও সন্তোষজনক নয়।
এছাড়া, ইউনূস তার বক্তব্যে জলবায়ু সংকটকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কথা বলেন। তিনি বলেন, “এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শুধু মেরামত করার কথা বলবে না, বরং আমাদের আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য একটি নতুন পথে নিয়ে যাবে। এটি একটি বৃহৎ কাজ, এবং এতে অনেক প্রশ্নও উঠবে।”
বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, “জলবায়ু সংকট আরো তীব্র হচ্ছে, কারণ আমরা আত্মবিধ্বংসী মূল্যবোধ প্রচার করে চলেছি। আমাদের সভ্যতা গুরুতর ঝুঁকিতে রয়েছে। একটি নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের জন্য আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, আর্থিক এবং যুব শক্তিকে একত্রিত করতে হবে, এমন একটি সভ্যতা যেখানে নিজেই নিজেকে রক্ষা করবে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “মানুষের কাজের কারণেই আজ আমাদের পৃথিবী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আমরা জানি, তবে এখনও এই ধ্বংসপ্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা এমন একটি জীবনধারা বেছে নিয়েছি, যা পরিবেশের ক্ষতি করছে।”
তিনি আরও বলেন, যে অর্থনৈতিক কাঠামো আমরা গড়ে তুলেছি, তা শুধুমাত্র সীমাহীন ভোগের দিকে উৎসাহ দেয়। যত বেশি ভোগ, তত বেশি উৎপাদন এবং লাভ। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সবকিছু পরিচালনা করছে, যাতে সর্বোচ্চ লাভ অর্জন করা যায়।
ইউনূস বিশ্বাস করেন, শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ, শূন্য দারিদ্র্য এবং শূন্য বেকারত্ব অর্জন করে মানুষ এমন একটি জীবনধারা গড়ে তুলতে পারে যা পরিবেশের ক্ষতি না করে বরং পৃথিবীকে রক্ষা করবে।
তিনি বলেন, শূন্য বর্জ্যের নীতি মানুষের ভোগে লাগাম দেবে এবং শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ব্যবহার করবে, যার ফলে কোনো বর্জ্য থাকবে না। এটি এমন একটি জীবনধারা, যেখানে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হবে না। মানুষের চাহিদা মেটাতে কেবল নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার হবে।
এই নতুন অর্থনীতি গড়ে উঠবে শূন্য ব্যক্তিগত লাভের নীতিতে, অর্থাৎ সামাজিক ব্যবসার ভিত্তিতে। এটি এমন ব্যবসা কাঠামো, যার উদ্দেশ্য হবে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধান করা, লাভ নয়।
ইউনূস আরও বলেন, সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা মানুষের জীবন উন্নত করবে। এটি তরুণদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং চাকরিপ্রার্থী তৈরি করার শিক্ষা ব্যবস্থার বদলে উদ্যোক্তা তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
তিনি বলেন, পরিবেশের নিরাপত্তার জন্য একটি নতুন জীবনধারা প্রয়োজন, যা চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং মানুষের কাছে একটি সুযোগ হিসেবে থাকবে। তরুণরা সেই জীবনধারাকে গ্রহণ করবে।
“প্রতিটি তরুণ শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদের পুঞ্জিভূতকরণ এবং শূন্য বেকারত্বের নীতি নিয়ে বেড়ে উঠবে। এটি হবে সামাজিক ব্যবসা গড়ে তোলার মাধ্যমে, এবং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের তৈরি করার মাধ্যমে।”
তিনি বিশ্বাস করেন, এই নতুন সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব, এবং তার জন্য মানুষকে একটি মঙ্গলজনক জীবনধারা বেছে নিতে হবে। বাকিটা তরুণ প্রজন্ম করবে, কারণ তারা এই পৃথিবীকে ভালোবাসে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিজ্ঞানী, নীতি নির্ধারক এবং অধিকারকর্মীদের উদ্দেশে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আশা করি, আপনারাও আমার সঙ্গে এই স্বপ্নের পথে যোগ দেবেন। আমরা যদি একসাথে স্বপ্ন দেখি, তাহলে তা বাস্তবায়িত হবে।”