মরনোত্তর ২১শে পদক পেলেন কুলাউড়ার সাবেক সাংসদ মরহুম আব্দুল জব্বার
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:১০:০১,অপরাহ্ন ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৭১৯ বার পঠিত
মাশরুর ফারহান তাহসিন, কুলাউড়া মৌলভীবাজার : কুলাউড়ার সাবেক সাংসদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, কেন্দ্রীয় কৃষকলীগের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত), মরহুম আব্দুল জব্বারকে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য সাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ (মরনোত্তর) একুশে পদক প্রদান করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অমর একুশে ফেব্রæয়ারী এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে ২০ গুণীজন এবং এক প্রতিষ্ঠানের মাঝে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসরকারী সম্মাননা ‘একুশে পদক’ বিতরণ করেন। ২০ ফেব্রæয়ারী বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের মাঝে পদক সমুহ বিতরণ করা হয়।
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বীর মুক্তিযুদ্ধা ‘মরহুম আব্দুল জব্বার (মরনোত্তর) একুশে পদক’ প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে গ্রহণ করেন তার পুত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার-২ মোঃ আবু জাফর রাজু। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৩ তোলা ওজনের ১৮ ক্যারেট সোনার তৈরী একটি স্বর্ণপদক, পুরস্কারের অর্থের চেক এবং একটি সম্মাননাপত্র প্রদান করা হয়েছে।
সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে.এম.খালিদ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মন্ত্রনালয়ের সচিব ড.মো.আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্বাগত বক্তব্য রাখেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন।
অনুষ্টানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ,প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সাবেক ও বর্তমান বিচারপতিগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনী প্রধানগণ, সরকারের উর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ, অতীতে একুশে পদক বিজয়ীগণ, বিভিন্ন দেশের কুটনীতিক ও সংস্থারপ্রধান এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
মরহুম আব্দুল জব্বার এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
মরহুম আব্দুল জব্বার বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার আলালপুর গ্রামে ১৯৪৫ সালে ১৭ নভেম্বর জম্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আব্দুল মজিদ এবং মাতা মরহুম সমিতা বানু।
আব্দুল জব্বার ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বলিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে সাথে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করতে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। ৬ মে পাকবাহিনী কুলাউড়া আক্রমণ করলে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগর চলে যান। ধর্মনগর ‘ইয়থ রিসিপিশন ক্যাম্প’ চালু করে তার চেয়ারম্যান হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও শরনার্থী ব্যবস্থাপনার জন্য গঠিত জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলের সদস্য এবং রিক্রুট ক্যাম্পের কো-চেয়ারম্যান ছিলেন এবং সেখানে অবস্থানরত জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পরামর্শ ও পরিকল্পনা করেন। তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা মুজিব বাহিনীর ৪ নং সেক্টরের অধীনস্থ মৌলভীবাজার সাব-সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে নিয়োগলাভ করেন এবং বিভিন্ন রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেন। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারে নৃশংস হত্যাকান্ডের অবিশ্বাস্য দুঃসংবাদ শুনে আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে ১৭ আগস্ট কুলাউড়া শহরে প্রতিবাদ সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল ও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রেক্ষিতে তিনি গ্রেফতার হন এবং এগারো মাস কারাবরণ করেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় রাজনৈতিক কার্যক্রম কাযক্রম শুরু করলে আবার গ্রেফতার হয়ে এক বছর কারাবরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি মেজর নুর কারাভ্যন্তরে তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন করে। আব্দুল জব্বার ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলন ও একুশে ফেব্রæয়ারি প্রভাতফেরি, প্লেকার্ড প্রদর্শন ও সমাবেশ করার কারণে ঐ রাতে গ্রেফতার হন এবং তিন মাস কারারুদ্ধ ছিলেন। তিনি ১৯৬৬ সালে বিত্তবানদের সহযোগীতায় কুলাউড়া শহরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। এছাড়া তিনি ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা, ৬৯’এর গণঅভ্যূত্থান এবং ৯০’র এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
আব্দুল জব্বার ছিলেন একজন মজলুম রাজনীতিবিদ এবং বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। মাটি ও অবহেলিত মানুষের সাথে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ছিল বর্নাঢ্যময় ও অহংকার করার মতো। তাঁর ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা, সততা, দক্ষতা, দলের প্রতি আনুগত্য, নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা, কর্মীর প্রতি স্নেহপ্রবণতা ও দেশপ্রেম-বিশেষ করে সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল আস্থা সকলকে অনুপ্রাণিত করে। আব্দুল জব্বার ১৯৭৯ সালে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সফল অংশ গ্রহণ তাঁর জীবনে শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে নির্দ্বিধায় অভিহিত করা যায়।
বঙ্গবন্ধু স্নেহধন্য ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের এ সংগঠক ১৯৯২ সালে ২৮ আগস্ট শোকের মাসে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে গৌরবজনক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আব্দুর জব্বারকে ২০২০ সালের “একুশে পদক” ( মরণোওর)-এ ভূষিত করা হয়।