“স্টেশন না থাকলে -বাজার তো আছে”। চোখে দেখা বিষয়গুলোর স্মৃতিচারণ
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৪৬:০১,অপরাহ্ন ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | সংবাদটি ১৫ বার পঠিত
আজকে স্টেশনটির বেহাল দশা।
সরকারি ভাবে স্টেশনের কাজ শুরু হওয়ার আগে থেকেই হিড়িক পড়ে গিয়েছিল ভাটেরার অধিকাংশ মানুষের মনে। কিভাবে বাজারের জন্য দোকানপাটের ব্যবস্হা করা যায়।
তখনকারসময় আমার দেখা ভাটেরার কিছু চিত্র ছিল এমন, যেহেতু তখনও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক বর্তমান সময়ের চেয়ে বেশী না হলেও কম ছিলো না। অবশ্য এরও অনেক আগে শুনেছি প্রায় ৯০ ভাগের মত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভাটেরায় বসবাস করত।
আমাদের পাড়াটি ছিল ” কোমার পাড়া” নামে পরিচিত। মাইজগাঁও গ্রামের কয়েকটি পাড়ার মধ্যে এটিও ছিল একটি, যা’ আজ অবধি অনেকের কাছে এ নামেই পরিচিত আছে। তবে কোন গেজেটে উল্লেখ নেই। তখনকার দিনে এই পাড়ার ধনী লোক ছিলেন ধন কোমার পাল ও মন কোমার পাল দুই ভাই। মন কোমার বাবু নি:সন্তান ছিলেন বিধায় ধন কোমার বাবুর ঔরসজাত হরি পদ পাল,কালী পদ পাল,অভিনাষ পাল ও তাঁদের বড় আরও দুই ভাই ছিলেন যাঁরা আগেই ভারত চলে গিয়েছিলেন। তাঁদেরকে আমি দেখনি। শেষপর্যন্ত এঁরাই হয়েছিলেন তাঁদের জ্যাঠা মশাই ও বাবা ধন কোমারের সম্পুর্ন সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।
এ পাড়ার অধিকাংশ লোকজনের পেশা ছিল মাটির বাসন পত্র তৈরী করা। তখন মাটির বাসনের প্রচলনই ছিল বেশী। হাড়ী পাতিল, কলস, বদনা, ঘটি বাটি, চাল রাখার ইয়া বড় কি জানি একটা, যা’কে “মুইটকা” বলা হতো। এই রূপকারদের মধ্যে সুনিল দা আর শুধু দা’ই ছিলেন সেরা। বাসন পুঁড়া দেয়ার জন্য তাঁদের খড়ের চালা একটা ঘর ছিল, যেখানে আমরা শীতের সময় আগুনের তাপে শরীর গরম করে নিতাম। এই ঘরটার নাম ছিল “ধুণ ঘর”। এই গ্রামের উত্তর পূর্ব কোণ জুড়ে যে পাড়াটি ছিল, তার নাম পাঠনী পাড়া। এ পাড়ার লোকেরা পেশায় ছিলেন মৎস্য জীবি। তাদের মধ্যে আজও কিছু লোক আছে যারা এ পেশার উপর নির্ভরশীল।
এর পশ্চিমে এসেই যে পাড়াটি, তা দাস পাড়া নামে পরিচিত। এখানকার কিছু লোকজন পূরানো লৌহ খন্ড দিয়ে দা, কুটার, কাস্তে, কোদাল ইত্যাদি তৈরী করতো। তাই এদেরকে “কামার” বলা হতো। এসব তৈরী যারা করতেন তাঁদের মধ্যে ভূবি দাস আর শুশি দাস এ দু’জন’ই ছিলেন আমার পরিচিত। এর আগে হয়তো আরও ছিলেন যাঁদের সম্মন্ধে আমি জানতাম না। যার কারণে দাস পাড়াকে অনেক সময় “কামার পাড়া” ও বলা হতো।
ভাটেরার মধ্যে সবচেয়ে বেশী পাড়া নিয়ে যে গ্রামটি, তা হচ্ছে মাইজগাঁও। এতবেশী পাড়া নিয়ে গঠিত ভাটেরায় এরকম দ্বিতীয় আর কোন গ্রাম নেই।
স্টেশন চালু হয় হয় অবস্থা।
ইন্ডিয়া থেকে কিছু মুসলমান তখন আমাদের দেশের হিন্দুদের সাথে জমিজমা বিনিময়ের মাধ্যমে এদেশে এসেছিলো। এর’ই ধারাবাহিকতায় স্টেশনের পূর্ব পাশে লাগোয়া বেশ জায়গার মালিক ছিল ইন্ডিয়া থেকে আসা মুসলমানরাই। তাঁদের কাছ থেকে অনেকে ক্রয়সূত্রে, আবার অনেকে জবর দখলের মাধ্যমে মালিক হয়ে দোকানপাট করতে শুরু করে।
ব্রাম্মণ বাজার টু ফেঞ্চুগঞ্জ রাস্তার পশ্চিম পার্শ্ব আর রেললাইনের পূর্ব পার্শ্বের মধ্যখানে ৩০/৩৫ ফিট, কোনখানে আবার ৪০ ফিটের মত জয়গা সরকারি। সেই জায়গাটা দখল করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেল অনেকেই।
তখন অল্প ক’টা দোকান চালু করে বাজারটি স্টার্ট করা হয়। তার মধ্যে ছিল – মরহুম হাজী মনজ্জির আলী, উনার পরিবর্তে উনার বড় ছেলে হীরা মিয়া, আকদ্দছ আলী সাহেব, আমার বড় ভাই ফজলুর রহমান রেনু মিয়া সাহেব।
তা পরে ক্রমান্বয়ে – বেণু ঠাকুর, নরী দাস, আশ্রব আলী, ময়না মিয়া, অরুণ ঘোষ, পুলিন ঘোষ, রেনু মিয়া, হাজী জমির আলী, আং লতিফ চৌ: কলা মিয়া, আং লতিফ লুলু, মিহী লাল দেব নাথ, রইছ আলী প্রমূখ। পুলিন ঘোষ বর্ষাকালে বাজারের উত্তর পাশের শ্মশানের পাশ দিয়ে বাড়ি যাওয়ার পথে “বাজ” পড়ে মারা গিয়েছিলেন।
তখনকার রাস্তার ছিল বেহাল দশা। বর্ষা মৌসুমে কাদা পানিতে নিমজ্জিত এই রাস্তা দিয়ে হাঁটাচলা বড়োই গোলমেলে। ক’জন একসাথে চলতে গেলে কখন যে, কে কার উপর পড়ে তা নিশ্চিত হয়ে বলা মুস্কিল ছিল। ফেঞ্চুগঞ্জ বা ব্রাহ্মণ বাজার যেতে হলে রাস্তায় যে কত ছড়া আর খাল, নালা পেরিয়ে যেতে হতো হিসেব ছাড়া। ছড়ায় প্রচুর স্রোত প্রবাহের সময় হলে তো আর কোন কথাই নেই।
শীত মৌসুমে অন্যরকম বিপদ। ধূলো আর বালুতে একাকার। পথ চলতে গেলে একটু পর পর ছড়ার পানিতে চোখ মুখ না ধুইলে বাকি রাস্তা টুকুন অতিক্রম করা অসম্ভব হয়ে যেত। রাস্তার দু’পাশের ঝোপঝাড় আর কেয়া বনের দিকে তাকালে মনে হতো, তারা যেন আগন্তুকের অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, যদি দয়া করে তাদের একটু ঝাড়া মুছা করে যায়। কতদিনের ময়লা শরীর নিয়ে মনের দূ:খে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। কে শুনে কার কথা।
শণিবার- মঙ্গলবার। সপ্তাহে দুই দিন বাজার
ফেঞ্চুগঞ্জ যাওয়ার সময় ডানপাশে রাস্তা ঘেঁষে স্ব দেব কূলীর বাড়ি। হাঁক ছেড়ে আকদ্দছ আলী, হীরা মিয়া অথবা ময়না মিয়া এঁদের কেউ বললেন, এই স্ব দেব! গাড়ি নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসো। কোন কোন দোকান থেকে কার কার মাল লোড করতে হবে তা স্ব দেবের জানাই থাকতো। মাল লোড করে দুইটা ষাঁড়ের কাঁদে জোয়াল বেঁধে ষাঁড় গুলোর পিছনে বাঁশের মাছায় তৈরী গাড়িতে তার দু’টো পা সামনের দিকে ঝুলিয়ে হাতে কঞ্চি নিয়ে ষাঁড় গুলোর লেজে নাড়া আর পিটে কঞ্চি দিয়ে চপেটাঘাত করতেই দে হেঁচকা টান। স্ব দেব রাজার হালে বসে আছে আর এদিকে ষাঁড় গুলো শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে টানছে তো টানছেই।
মহাজন সাহেবরা স্ব দেবের হাতে মালের টুকা ধরিয়ে দিয়ে হালকা পাতলা জিনিস গুলো হাতে নিয়ে বিকেল পাঁচটার ট্রেন ধরে নিজ নিজ দোকানে এসে ব্যবসায় জড়িত। রাত আটটা, স্ব দেবের জন্য অপেক্ষা শুরু। দোকান থেকে বেরিয়ে বেরিয়ে উত্তর দিকে তাকাচ্ছেন আর একজন আরেক জনকে বলছেন, কই এখনো আসে না কেন? অন্ধকারে কিছু ঠাহর ও করা যাচ্ছে না। কোন আলোও চোখে পড়ছে না। হাহুতাশ যখন চরম পার্যায়ে, তখন তাঁদের মধ্যে কেউ একজন বলে উটলেন – এ-ই যে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। আরেক জন বললেন হাঁ, তা-ই তো। এটাই স্ব দেবের গরুর গাড়ির লন্ঠনের আলো। একটু পরেই আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো, হেই যা, হেই হেই, মাঝে মাঝে কঞ্চির চপেটাঘাতের শব্দ। একসময় মাল বুঝাই গরুর গাড়িটি এসে দোকানের দোরগোড়ায় স্ব দেবের চ্ চ্ শব্দে ব্রেক করলো।
মালামালগুলো আনলোড করে বাড়ি ফিরতে মহাজনদের কোন কোন দিন রাত বারোটা একটার মত বেজে যেতো। তখন ছিল অল্প ক’টা দোকান মিলে বাজার। এসময় এই বেহাল দশার রাস্তায় ” বাস” গাড়ি চালানোর মত সাহস করেছিলেন যিনি, তিনি হচ্ছেন আমাদের হীরা মিয়া। রকিব আলী এবং আকুলের বড় ভাই। এই রাস্তার প্রথম গাড়ি ছিল উনার বাস গাড়িটা। এই গাড়িটিকে সবাই “মুড়ির টিন” বলতো।
আজ আমাদের এ বাজার হয়েছে লম্বায় প্রায় “হাফ” কিলোমিটারেরও বেশি। কি-না পাওয়া যায় ইদানীং আমাদের বাজারে! শুটকি থেকে শুরু করে টিভি, ফ্রিজ, এয়ারকুলার পর্যন্ত। সবচেয়ে বড় পাওয়া আমাদের ভাটেরার কেন্দ্রীয় মসজিদ। যার নাম ভাটেরা স্টেশন বাজার জামে মসজিদ।
লেখক : শাহ আজিজ ( পারুল), সমাজ কর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ভাটেরা।