নিউজ ডেস্ক : দেশের বিভিন্নস্থানের ন্যায় নানা আনুষ্ঠানিকতা ও ধর্মীয় ভাবগাম্বীর্যের মধ্যে দিয়ে কুলাউড়ার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের নবাব বাড়িতে পবিত্র আশুরা ১০ই মহরম পালিত হয়েছে। ‘হায় হোসেন হায় হোসেন’ মাতমে শিয়া সম্প্রদায়ের ভক্তবৃন্দ নিজ শরীর রক্তাক্ত করা ও মাতম বিলাপের মধ্য দিয়ে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা পবিত্র আশুরা পালন করেছে।
মঙ্গলবার ১০ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় নবাব বাড়ির হোসেনি দালান থেকে সু-সজ্জিত তাজিয়া মিছিল বের হয়। সুদীর্ঘ তিনশত বছর ধরে বৃহত্তর সিলেটের নবাব আলী আমজদের পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি বিজড়িত এই নবাব বাড়িতে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। শিয়া সম্প্রদায়ের কয়েকশ পুরুষ নানা অনুষঙ্গ, তাজিয়া, কালো, লাল ও সবুজ নিশান উড়িয়ে মিছিলে অংশ নেয়। খালি পায়ে মিছিলে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা শোকের প্রতীক কালো পোষাক পরিধান করে।
দিবসটি পালনে হাতির বহর নবাব বাড়ির প্রাচীন ঐতিহ্য হলেও এবার প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞায় তা সম্ভব হয়নি। মহরমকে কেন্দ্র করে নবাববাড়ির আশপাশের এলাকায় লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। বসানো হয় ভাসমান শতাধিক দোকান-পাট। দেশ- বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ও শিয়া সম্প্রদায়ের লোক সহ মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আশুরা উপলক্ষে এখানে ছুটে আসেন। প্রায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে নবাববাড়িতে।
পহেলা মহরম থেকে দশ মহরম পর্যন্ত পৃথিমপাশা নবাব বাড়ীর ইমামবাড়া, তরপি সাহেব বাড়ী, ছোট সাহেব বাড়ী, মরহুম শাহাদাত হোসেনের বাড়ী, বাঘ বাড়ী, মনরাজ সাহেব বাড়ী, পাল্লাকান্দি সাহেব বাড়ী প্রমুখ ইমাম বাড়া গুলোতে মহরম ও কারবালার ইতিহাস স্মরণে মজলিশ, মাতম, নোওহা, জিয়ারত, দোয়া, জারি অনুষ্ঠানাদি হয়। নবাব বাড়ির ইমামবাড়ায় ১০ দিন ব্যাপি মহরম ও আশুরার ইতিহাসের উপর বয়ান রাখেন মাওলানা মোহাম্মদ নুরে আলম, মাওলানা সৈয়দ মো. রেজা ও মাওলানা মো. আব্দুল লতিফ।
সরেজমিন দেখা যায়, মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে তিনটায় নবাব বাড়ির হোসেনি দালান থেকে তাজিয়া মিছিলসহ ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ ধ্বনিতে শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীরা নিজের শরীর রক্তাক্ত করে মিছিলটি আলী আমজদ স্কুল এন্ড কলেজের সম্মুখে রবিরবাজার পদ্মদিঘির পার স্থানীয় কারবালা প্রান্তরে (কবরস্থানে) গিয়ে সমবেত হয়। সেখানে মহরমের সেই বিষাদময় দিনে ইমাম হোসেনের করুন মৃত্যুর প্রতিবাদে ‘হায় হোসেন হায় হোসেন’ মাতম করে আবারও নিজের শরীর রক্তাক্ত করে কারবালার শোকে শোক পালন করেন।
কালো জামা রক্তে ভিজে চুপসে গেছে আর সাদা জামা হয়ে উঠে রক্তে রঞ্জিত। তবুও হায় হোসেন, হায় হোসেন, ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছে নবাব বাড়ির আকাশ-বাতাস। তাজিয়া মিছিলে বুক চাপড়ে, জিঞ্জির দিয়ে শরীরে আঘাত করে প্রকাশ করা হয় মাতম। কেউ আবার ধারালো ছোরাগুচ্ছ দিয়ে নিজ শরীর ও মাথা রক্তাত্ব করতে দেখো যায়।
পৃথিমপাশার শিয়া অনুসারীরা জানান, মিছিলের শুরুতেই দুটি কালো গম্ভুজ বহন করা হয় বিবি ফাতেমার স্মরণে। এছাড়াও মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন নিশান নিয়ে আসেন। যে যার মতো এই নিশান বহন করেন। মিছিলের মধ্যে হায় হোসেন, হায় হোসেন করে শোকের গান গাওয়া হয় সমবেত কন্ঠে। এছাড়াও অনেকেই বুক চাপড়ে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ বলে মাতম করতে থাকেন। আশুরার দিনে তাজিয়া বের করা হয় শোকের আবহে। মূলত ইমাম হোসেন (রা.) এর সমাধির প্রতিকৃতি নিয়ে এই মিছিল হয়। তাজিয়া মিছিলের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন জানান- কারবালার শোককে ধারণ করে এ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মাতম করে শোক প্রকাশ করি সবাই।
এদিকে নবাব বাড়িতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক স্থরের নিরাপত্তা চাদরে বেষ্টনি তৈরি করা হয়। লক্ষাধিক মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠা ঐতিহ্যবাহি নবাববাড়িতে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রাখা হয়। স্পর্শকাতর জায়গা মোতায়েন করা হয় বিভিন্ন থানার পুলিশসহ অতিরিক্ত পুলিশ ও গ্রাম পুলিশ । সব-রকমের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুরো নবাব বাড়ি জুড়েই র্যাব, ডিবি পুলিশ এবং গোয়েন্দা পুলিশ প্রস্তুুত ছিলো বলে জানিয়েছেন কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ ইয়ারদৌস হাসান।
মহরম অনুষ্ঠানের মোতাওয়াল্লী ও সাবেক তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য এ্যাড. নওয়াব আলী আব্বাছ খাঁনকে দেখা যায়, কারবালা প্রান্তরে ধারালো ছোরাগুচ্ছ দিয়ে নিজ মাথা রক্তাক্ত করতে। কথা হয় তাঁর সাথে। তিনি বলেন, আজকের এই দিনটির আমাদের জন্য অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। শরীরে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে উপলব্ধি করতে চাই কেমন ছিলো হোসাইনের যন্ত্রণা। এই দিবসটি আমাদের বাড়ির ঐতিহ্য। এদিকে শান্তিপূর্ণভাবে আশুরা পালিত হওয়ায় নবাব বাড়ির পক্ষ থেকে প্রশাসনসহ সর্বস্তরের জনসাধারণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন অনুষ্ঠানের মোতাওয়াল্লী সাবেক এমপি নবাব আলী আব্বাছ খাঁন।