নিজেদের গৃহবিবাদেই হুমকির মুখে ৩৩ বছরের জাতীয় পার্টি
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:৪৪:২৯,অপরাহ্ন ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ৩৮৬ বার পঠিত

রংপুরের মাটি এরশাদের ঘাটি- রংপুরের মাটি জাতীয় পার্টির ঘাটি। নিজেদের গৃহ বিবাদে আজ এ ঘাটি হুমকির মূখে পড়েছে জাতীয় পার্টির ৩৩ বছরের ইতিহাস। সাড়ে চার লাখ ভোটারের এ নির্বাচনী আসনটি ৩৩ বছর ধরে দখলে রয়েছে জাতীয় পার্টির (জাপা)। রংপুরের ছওয়াল এরশাদের আসনটি শূন্য হয়েছে সম্প্রতি তার মৃত্যুর পর। কিন্তু এরশাদ শূন্য বাস্তবতায় এ আসনের উপ-নির্বাচনের সমীকরণ কী হতে পারে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় ৯ মাস ৪দিন পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ উপ-নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি প্রধান তিন রাজনৈতিক দল নতুন করে নিজেদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা করছে। পুরনো সমীকরণ বাদ দিয়ে তিন দলই নতুন করে হিসেবে নিকেশ করতে চায় এ উপ-নির্বাচনে। শেষ পর্যন্ত যেই জিতুক রংপুরের রাজনীতিতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য নতুন কিছু ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তিন দলই আলাদা করে তাদের প্রার্থী দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. রেজাউল করিম রাজু, সদ্য প্রয়াত রংপুর-৩ আসনের জাতীয় সংসদ্য ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদএরশাদের পুত্র জাতীয় পার্টিও প্রার্থী রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ, বিএনপির রিটা রহমান এ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। এর বাইরে এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার লাঙ্গল প্রতীক না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।
১৯৮৬ সালে শামরিক শাসনের শুরু থেকেই রংপুর সদর জাতীয় পার্টির কব্জায়। সে সময়ের নির্বাচনে শফিউল গনি স্বপন এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় সামরিক শাসক এরশাদের। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে কারাগারে বসেই রংপুর সদরসহ ৫টি আসনে নির্বাচন করে সবকটিতেই জয়লাভ করেন এরশাদ। এরপর ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ এর সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকেই নির্বাচিত হন তিনি।
২০০১ সালের নির্বাচনে আইনগত বৈধতা না পাওয়ায় নির্বাচন করতে পারেননি এরশাদ। সেবার তার ছোট ভাই জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের ওই আসন থেকে নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনটি তিনি ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে তার সহধর্মীনি বেগম রওশন এরশাদ এখান থেকে জিতে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এ আসনের বহু অংশিদার জুটে যায়। এ আসনে হিস্যা কোন পক্ষে যাবে এবং কেন্দ্রে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা কীভাবে হবে-এ নিয়ে দলের দুই প্রধান নেতা জি এম কাদের ও রওশন এরশাদ, যাদের ওপর এরশাদ জাতীয় পার্টির দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন। তারাই বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। ফলে ভাঙ্গনের শঙ্কা দেখা দেয় দলে।
এ অবস্থায় শীর্ষ কয়েকজন নেতার তৎপরতায় ক্ষমতার ভাগাভাগি হয় জাতীয় পার্টিতে। সমঝোতা হয় রংপুর-৩ আসন মানে এরশাদের শুন্য আসনে জাতীয় পার্টির উত্তরসূরি কে হচ্ছেন তা নিয়ে। স্থানীয় জাপার প্রবল বিরোধিতা ও অসহযোগিতার হুমকির পরও এরশাদ-রওশনপুত্র সাদ এরশাদকে জাপার প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়। রংপুর জাপার এই বিদ্রোহের কেন্দ্রে রয়েছেন পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য,রংপুর মহানগর জাপার সভাপতি ও রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। সাদ এরশাদকে প্রার্থী করা হলে তার সঙ্গে অসহযোগিতামূলক আচরণ করা হবে ঘোষণা করেন মহানগর জাপার প্রতাবশালী এই নেতা।
কেন্দ্রের শীর্ষ দুই নেতার সমঝোতার ভিত্তিতেই সাদ এরশাদ রংপুর-৩ (সদর) আসনে উপ-নির্বাচনে জাপার প্রার্থী হন। এ সমঝোতার নেপথ্যের কুশীলব ছিলেন জাপা মহাসচিব ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব মোঃ মসিউর রহমান রাঙ্গা এমপি। লাঙ্গলের প্রার্থী হিসাবে সাদের মনোনয়নপত্র জমা ও নির্বাচনী কর্মকাণ্ড দেখভাল করছেন স্বয়ং।
কিন্তু এ আসনে সাদের সাফল্য নির্ভর করছে বেকে বসা পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুরের নগরপিতা মেয়র মোস্তফার সঙ্গে কতটা সমঝোতা হচ্ছে, তার উপরেই। লাঙ্গলের প্রার্থী না হতে পেরে স্বতন্ত্রপ্রার্থী এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার এই উপ-নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। রংপুরের সন্তান ও এরশাদের পরিবারের সদস্য- এ দুই সেন্টিমেন্ট তার দিকেই। আর মেয়র মোস্তফাসহ স্থানীয় নেতাদের সমর্থন পেলে তার জনসমর্থনের পাল্লা অনেকটা ভারি হবে তার দিকেই।
এরই মধ্যে আসিফকে ঠেকাতে আওয়ামী লীগ যাতে সেখানে প্রার্থী না দেয় এ রকম সমঝোতার চেষ্টাও করেছে কেন্দ্রীয় জাপা। তবে সেটা এখনো সমঝোতা হয়নি। আগামী ৫ অক্টোবর রংপুর-৩ আসনে উপ-নির্বাচনে জাতীয় পার্টির জন্য একেবারেই নতুন সমীকরণ নিয়ে হাজির হচ্ছে। ৩৩ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম লাঙ্গল এ আসনে একটা অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়েছে। নিজেদের গৃহবিবাদেই জাতীয় পার্টির আজ এ হাল। আর তাই এ উপ-নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টিকে হালখাতায় নতুন হিসাব খুলতে হতে পারে।
রংপুরের ৬টি আসনের মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪টি আসন জাতীয় পার্টির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন আওয়ামী লীগ। আগামী ৫ অক্টোবর রংপুর-৩ আসনের উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির দুর্গ রংপুরে হানা দিতে চায়। এরশাদ-পরবর্তী জাতীয় পার্টির মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রংপুর বিভাগের সব আসনেই নিজেদের শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে আওয়ামী লীগ। সাদ-আসিফকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক জাপার যে বিভক্তি সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে লাঙ্গলের মাটিতে উপনির্বাচনে জয় ছিনিয়ে আনতে চায় নৌকা। এ উপ-নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের হালখাতায় রংপুর জয়ের হিসাব-নিকাশই লিখতে চায়।
ফলে রংপুর-৩ সদর আসনের উপ-নির্বাচনে রাজনৈতিকভাবে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের সমঝোতা না হলে এবারেই নিজেদের শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে আওয়ামী লীগ আর প্রতিষ্ঠা পেতে পারে আওয়ামী লীগের নতুন ঘাটি হিসেবে রংপুর।