তারে ভুলি কী করে?
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:৩৯:৪৫,অপরাহ্ন ০৮ অক্টোবর ২০১৯ | সংবাদটি ৪৭২ বার পঠিত
প্রফেসর ড. আতিউর রহমান : এমন করে পরিবারের সবাইকে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে সে চলে যাবে তার জন্যে একদম তৈরি ছিলাম না। বয়স হয়েছিল। চলতে ফিরতে কষ্ট হচ্ছিল। ডাক্তার দেখাচ্ছিলাম। কয়েকবার হাসপাতালেও নিয়ে গেলাম। সেলাইন দেয়া হলো বেশ ক’বার। ইনজেকশন দেয়া হচ্ছিল। আরেক ডাক্তার কিছু ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ দিলেন। কিন্তু গত দু’তিন ধরে সিরিঞ্জে করে খাবার বা ওষুধ যাই মুখে দিচ্ছিলাম তাই কিছুক্ষণ পরে বমি করে ফেলে দিচ্ছিল। নিজে থেকে ইচ্ছে করে কিছুই খাচ্ছিল না। পাঁচ অক্টোবর ২০১৯ সকালেও পা টেনে টেনে হেঁটে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর একটু আগে খাওয়ানো ওষুধ ও ফুড সাপ্লিমেন্ট বমি করে ফেলে দিল। মনে শঙ্কা নিয়েই আমার কর্মক্ষেত্র উন্নয়ন সমন্বয়ে এলাম। দুপুরের পর আমার স্ত্রী সাহানা ও ছোটমেয়ে প্রকৃতি ওষুধ খাইয়েছে। ইনজেশনও দিয়েছে। কিন্তু সব বমি করে ফেলে দিয়েছে। ওকে এভাবে অনেকটা জোর করে খাওয়ানোর জন্যে নাকি রাগও করেছিল। বেশ বকেও ছিল। রাগ করে গৃহকর্মী চাইনার ঘরে চলে গিয়েছিল শুধু সামনের দু’পায় ভর করে। পেছনের পাদুটোতে কোনো বল ছিল না। আমাদের মেঝ মেয়ে অর্চি সিঙ্গাপুরে থাকে। তার সাথে সাহানা ও প্রকৃতি কথা বলতে শুরু করলে শব্দ পেয়ে আবার সেভাবেই দু’পায়ে কষ্ট করেই আমাদের ঘরে আসে। আমি গুলশান-বনানী পূজা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে ছিলাম। রাত সাড়ে আটটার দিকে সেখান থেকে বের হয়ে দুষ্টুর খোঁজ নিলাম। সাহানা বলল চুপচাপ শুয়ে আছে। ডাক্তারকে পরের দিন (৬ তারিখ) সকালে একটু আসার অনুরোধ করলাম। তিনিও রাজিও হলেন। রাত সাড়ে ন’টার পর বাড়ি ফিরলাম। ফের ডাক্তারের সাথে আমরা কথা বললাম। তিনি একটু একটু করে পানি মুখে দিতে বললেন। সিরিঞ্জে ভরে পানি তুলে দিলাম সাহানার হাতে। একটু পানি খেলও। আরেকটু দিতে বললাম। এর একটু পরেই বমি করে সব ফেলে দিল। তার একটু পরেই মুখ উঁচু করে দুটো হেচকি দিল। এরপর জিহ্বা বের করে দিল। আমি বুঝি নি। আমার স্ত্রী ডাক্তার। বললো ‘দুষ্টু’ চলে গেল। প্রকৃতিকে তাড়াতাড়ি ডাকো। প্রকৃতি তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় দুষ্টুর পেটে হাত রেখে বললো, ‘এখনো তো নিশ্বাস নিচ্ছে।’ প্রকৃতির মা কাঁদছে। বললো, ‘না মা সব শেষ।’ জীবনে এই প্রথম চোখের সামনে এভাবে চিরদিনের জন্যে একটি প্রাণকে চলে যেতে দেখলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তখনও জ্বল জ্বল করছে চোখ। শুধু শরীর নিস্তেজ। সবাই আমরা কাঁদছি। বিদেশে মেয়েদের সাথে কথা বলেছি আর কেঁদেছি। আর ভাবছি একটি অবলা প্রাণী কেমন করে এমন আপনজন হতে পেরেছিল। পরিবারের সবচেয়ে আদরের সদস্যকে তার পরিণত বয়সে হারিয়েও আমরা দিশে হারা।
কে এই দুষ্টু? এমন করে মায়ার বাঁধনে কি করে সে বেঁধেছিল পুরো পরিবারকে? প্রায় ষোল বছর আগের কথা। আমাদের ছোট মেয়ে প্রকৃতির জন্মদিনে তার হাবিব মামা পুতুলের মতো দেখতে সাদা ধব ধবে দুষ্টুকে উপহার দেয়। জার্মান স্পিৎজ জাতের এই কুকুরটির বয়স তখন মাত্র দু’মাস। কোলে করে তাকে এনেছিল হাবিব। প্রকৃতি ও তার বোনেরা হঠাৎ খুশিতে আত্মহারা। অনেক দিন ধরেই প্রকৃতি এমন একটি পোষা প্রাণির জন্যে বায়না করছিল। কতদিন তাকে কাটাবনে নিতে হয়েছে এমন পোষাপ্রাণী দেখাতে। বুঝিয়ে বলেছি এমন প্রাণি যখন চিরদিনের জন্যে চলে যাবে তখন যে কষ্ট হবে তা সহ্য করা কঠিন হবে। ছোট্ট মানুষ। মন খারাপ করে ঘরে ফিরত। শেষ পর্যন্ত পছন্দের প্রাণিটিকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে পেয়ে কতোই না খুশি। ওর মেঝবোন অর্চি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল এমন কোনো পোষাপ্রাণী পেলে তার নাম রাখা হবে দুষ্টু। অর্চি বইয়ের পোকা। সুনীল গঙ্গোপাদ্যায়ের কোনো একটি লেখায় দুষ্টু নামটি পড়েছে। ওদের মাও খুবই পোষা প্রাণীভক্ত। তার ছোট বেলাতেও পোষা কুকুর ও বিড়াল নিয়ে ছিল গভীর আগ্রহ। ‘জন’ ও ‘ভূট্টো’ ছিল তাদের পোষা কুকুরের নাম। তাই দুষ্টুর আগমনে বাড়ি ভরে গেল। মা ও মেয়েদের আনন্দ দেখে কে! আমি গ্রামের মানুষ। কুকুরের সাথে তেমন সখ্যতা গড়ে ওঠে নি। তাই দুষ্টুকে দেখে একটু ভয়ই পেতাম। শুরুতে তাই একটু দূরে দূরেই থাকতাম। কিন্তু ওর মায়াবি চোখ, নরম স্বভাব আমাকেও আকর্ষণ করতে শুরু করলো। তখন থাকতাম পরিবাগের বাড়িতে। সারা দিন ঘরে থাকলেও রাতে নীচে রাখা হতো। আমরা যা খেতাম তাই খেত। প্রতি শুক্রবার গোসল করাতো আমার স্ত্রী। আমি ধীরে ধীরে তার সহযোগী হয়ে গেলাম। পানি ঢেলে দিতাম। সাবান এগিয়ে দিতাম। গোসল শেষে কী মমতায় সাহানা দুষ্টুকে তাওয়ালে জড়িয়ে রোদে নিয়ে যেতো তা না দেখলে বোঝা মুশকিল। অনেকক্ষণ ধরে তাকে শোকাতো, আঁচড়ে দিত, পাওডার মাখতো। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে তার এই প্রাণিপ্রীতি লক্ষ্য করতাম। এর মধ্যে আমি ব্যাংকক গেলাম। ওখান থেকে শ্যাম্পু, সাবান, পাউডার. চিরুনি, সুগন্ধি স্প্রে ও হাঁসের মাংস দিয়ে তৈরি খাবার নিয়ে এলাম। সবাই খুশি। এরপর থেকে যখনই বিদেশে গিয়েছি তখনই দুষ্টুর জন্যে এসব ছাড়াও আরো কতো কি এনেছি। শীতের কাপড়, মুখের ঠুলি, গলার বেল্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই জানতো আমি বিদেশে গেলেই দুষ্টুর জন্য কিছু না কিছু আনবই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার সহকর্মী ড. মহম্মদ আবু ইউসুফ ও আমার সাথে ওর জন্য কেনাকাটায় অংশগ্রহণ করেছে। নিউইয়র্কে টিটো সব সময় আমার সাথে এসব কেনাকাটায় থাকতো। ও ভালো গান গায়। একবার ঢাকায় এসে দুষ্টুর গান শুনে খুব খুশি হয়েছিল। মুখে হারমনিকা বাজালেই দুষ্টু সুর করে গানের মতো আওয়াজ করতো শেষ দিকে আর সে গান গাইতে পারতো না। সর্বশেষ, গত মাসেও কাঠমুন্ডু থেকে তার জন্য নরম ‘চিউইং বোনস’ এনেছিলাম। অসুখ সত্ত্বেও খেয়েছে এক দুটি। এসব প্রাণি সাধারণত চৌদ্দ পনেরো বছরের বেশি বাঁচে না। সে বিচারে প্রায় ষোল বছর ধরে আমাদের ঘরকে আলোকিত করেছে দুষ্টু। বলা যায় পূর্ণ বয়সেই চলে গেল। তবু আমরা দুঃখে ভারাক্রান্ত।
আজ মনটা খুবই বিক্ষিপ্ত। কতো স্মৃতিই না মনে পড়ছে। পরিবাগ থেকে আমরা ধানমন্ডির ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠলাম। সেখানে দুষ্টুকে নিয়ে খানিকটা বিব্রতই ছিলাম। সাহানা শুরুতেই অন্যান্য ফ্ল্যাটমালিকদের বলে দেয় যে ও আমাদের পরিবারেই সদস্য। তাই তার ওপর যেন অযথা কোনো বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি না করা হয়। দিনে দু’তিনবার ফ্ল্যাটের বাইরে নিয়ে যেতে হতো। আমাদের গাড়ির চালক মজিবর, জামান এবং পরে মিঠু ও শুকুর ওকে বাইরে নিয়ে যেতো। লেকের পাড়ে ঘুরে আসতো। আমিও মাঝে মাঝে নিয়ে যেতাম। সাহানাও নিত। শেষ দিকে আবাসন কর্মী শামসু, মাহবুব, রাজুসহ অনেকেই ওর বন্ধু হয়ে যায়। ওরাই বাইরে নিয়ে তার টয়লেট করিয়ে আনতো। শেষ দিকে প্রায় পনের দিন আর বের হতে পারে নি। ঘরে বা বারান্দাতেই টয়লেট সারতো। আমরা পরিস্কার করতাম। সাহানা হাতে গ্লাবস পরে কি যত্ন সহকারে যে এ কাজটি করতো তা সামনাসামনি না দেখলে বোঝানো মুশকিল। মাত্র দুদিন আগেই ওকে ছাদে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রকৃতি সাথে ছিল। ছাদে ও ঘুরে ঘুরে টয়লেট ও বমি করলো। আমি গ্লাবস পরে পরিস্কার করলাম। ধুয়ে দিলাম। আমার একটুও খারাপ লাগেনি। মনে হলো নিজের সন্তানের যত্নই নিচ্ছি। প্রকৃতি ওকে কোলে করে ছাদে নিল এবং ঘরে ফিরিয়ে আনলো। সেই ওর শেষবারের মতো ছাদে যাওয়া।
মাঝাখানে অবশ্যি প্রায় সাত বছর গুলশানে গভর্নর ভবনে ছিল দুষ্টু। বিরাট বাড়ি। খুবই খোলা মেলা। অনেক মানুষ। কেয়ার টেকার সুরুজ মিয়া তার অভিভাবক। রানা, ইয়াকুব, মইনুল, আছিয়া-সবাই ছিল দুষ্টুর বন্ধু। তারা সবাই মিলে দুষ্টুকে বড় সুখে রেখেছিল ঐ কবছর। রাতে দুষ্টু সারা বাড়ির ওপর নজর রাখতো। নিরাপত্তা কর্মীরা প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়তেন। তাদের ওপর নজরদারি করতে আসতেন তত্ত্বাবধায়করা। তারা গেটে এলেই গর্জে উঠতো দুষ্টু। সাথে নিরাপত্তা কর্মীরা জেগে উঠতেন। এভাবেই তাদের চাকুরি রক্ষা পেতো। তাই তারাও খুব পছন্দ করতেন দুষ্টুকে। সুরুজ মিয়া দুষ্টুকে নিয়ে গভর্নর ভবনের বাইরেও যেতেন। আশেপাশের মানুষেরও প্রিয় ছিল দুষ্টু। গভর্নর ভবন ছেড়ে ফের ধানমন্ডি। যেমনটি আগেই বলেছি ফ্ল্যাটবাড়ি সত্ত্বেও দুষ্টুকে নিয়ে অনেকেই বাইরে যেতেন। সুরুজ মিয়া এখন অবসরে। তবু মাঝে মাঝে আসতেন দুষ্টুকে দেখতে। কিনা খুশিই হতো দুষ্টু তাকে পেয়ে! কিছু দিন আগে রানাও এসেছিল তার মেয়েদের নিয়ে। দুষ্টু ঠিকই তাকে চিনতে পারলো।
ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে যে কেউ বেড়াতে এলে দুষ্টু অবশ্যি এসে আমার কাছাকাছি বসতো। খুব বেশিক্ষণ আড্ডা মারলে সে তা শেষ করার সিগনাল দিত। সামনের দু’পায়ে মেঝের কার্পেট আঁচড়াতো। তাকে আদর করে থামাতে হতো। সোয়েব চৌধুরি, অরিফজ্জামান, আসাদ, সানোয়ার, বুলবুলসহ যারাই আসতেন তারাই তার বন্ধু হয়ে যেতেন। অনেকের বাচ্চাদের আলাদা আকর্ষণ ছিল দুষ্টু। দুষ্টুকে দেখার জন্যে বাচ্চারা আবদার করতো তাদের বাবা মার কাছে।
ময়লা সংগ্রহকারির সাথে তার বিবাদ লেগেই থাকতো। ময়লা দেবার সময় তাই আমাদের একটু সাবধান থাকতে হতো। অন্যদিকে আমাদের গৃহকর্মী, ঘর পরিস্কারকর্মীদের সাথে ছিল তার ভীষণ ভাব। তাদের হাতে খেতো। রান্না ঘরে গিয়ে বসে থাকতো।
মাঝে মাঝে অফিসে নিয়ে আসতাম। পুরো অফিস ঘুরে বেড়াত। আমার ঘরে ঢোকার সময় নক করতো। খুলে দিলে এসে আমার চেয়ারের পাশেই বসতো। অফিসের সবার সাথেই ছিল তার সুসম্পর্ক। দর্শনার্থীরাও তাকে দেখে অবাক হতো না। উন্নয়ন সমন্বয়ের পিকনিকে দুবার যোগ দিয়েছে দুষ্টু। সাভারে এক বার তো অন্য ছাড়া কুকুদের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়েছিল দুষ্টু। সবার সাথে খুবই আনন্দে কেটেছে তার পিকনিকের দিনগুলো।
আরেকবার, হবিগঞ্জে ‘দ্যা প্যালেসে’ নিয়ে গিয়েছিলাম তাকে। সঙ্গে ছিল প্রকৃতি ও তার মা। আমরা আলাদা একটা কটেজে ছিলাম। বেড়াতে গিয়ে প্রকৃতি তার গলার শিকল খুলে দিয়েছিল। দুষ্টু গাছের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ওপারে গিয়ে দেখে নীচে বিরাট খাদ। আর এপারে আসতে পারছে না। প্রকৃতি ও তার মা খুবই উদ্বিগ্ন। পড়ে গেলে একদম শেষ। অনেক বুদ্ধি করে দুষ্টু গাছের ঝোপ এড়িয়ে এ পারে এসেছিল। পা কেটে গিয়েছিল। খুব ভয় পেয়েছিল। ভয় কাটাতে মাঝরাতে খাটের পাশে শুয়ে থাকা দুষ্টু লাফ দিয়ে ওপরে উঠে আমাদের পাশে এসেছিল।
প্রকৃতি বিদেশে পড়তে গেলে দুষ্টু বড় একা হয়ে পড়ে। তবে প্রকৃতির মা তাকে আগলে রেখেছে মন প্রাণ দিয়ে। কয়েকবার আমরা বিদেশে গিয়েছি দুষ্টুকে হাবিবের বাড়িতে রেখে। বিদেশে গিয়েও ক্ষণে ক্ষণে দুষ্টুর খোঁজ করতো প্রকৃতি ও তার মা। হাবিব ও তার ছেলে মেয়েরা খুবই আদর করতো তাকে। তবুও দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই প্রকৃতি ও তার মায়ের।
আজ মনে হচ্ছে আমি একজন প্রকৃত বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার দুঃসময়ের বন্ধু দুষ্টুকে হারিয়ে আমার কষ্টের শেষ নেই। ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ। আমার স্ত্রী কন্যারা বিদেশে। গভর্নর ভবনে অনেকেই আছেন। কিন্তু আপনজন শুধু দুষ্টু। আমি সকালে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে ভবনে ফিরেছি। শুভাকাঙ্খী ও গণমাধ্যমকর্মীরা গিজ গিজ করছেন। তাদের নিশ্চয় মনে আছে ঐ সময়টা দুষ্টু আমার পাশ এক দণ্ডের জন্যেও ছাড়েনি। সে মনে হয় বুঝতে পেরেছিল আমার মন খারাপ। ষড়যন্ত্রকারীরা ফের হামলা করতে পারে তার চোখে মুখে সেই ভয় ছিল। এর আগেও দেখেছি আমার যে কোনো বিপদে আমার একান্ত কাছে চলে আসতো দুষ্টু। লন্ডনে আমার বড় অপারেশন হয়। এর কয়েক বছর পর ফের আবার ঐ ধরণের আরেকটি অপারেশন ঢাকায় করতে হয়। সে সময় ভালোভাবে চলতে ফিরতে পারি না। আমার খাটের পাশে সারাক্ষণ শুয়ে থাকতো। বাথরুমে গেলে দরজায় বাসে থাকতো। ভাবখানা, আমি তো আছি তোমার কিসের ভয়! প্রতিবার আমরা ঘরে ফিরলে দরজা না খোলা পর্যন্ত হৈ চৈ করতো। ঘরে ফিরে ওকে হাসের মাংসের ‘টিট’ দিতে হতো। শুধু আমার কাজ থেকে নিতো। বিদেশ থেকে প্রকৃতি বা অর্চি এলে জড়িয়ে ধরতো। ওদের মা বাইরে গেলে খুব মিস্ করতো। ফিরলে একই ধরণের আচরন করতো। সবার জন্যেই ওর ভালবাসার কোনো তল ছিল না। তাই এমন গভীর ভাবে আমার তাকে মিস্ করছি।
আমার সেই দুর্দিনের সাথী, আত্মার আত্মীয় দুষ্টুকে আজই সকালে আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে লেকের পারে সমাহিত করা হয়েছে। সেখানে একাধিক ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। যখন ফুল ফুটবে তখন মনে হবে আমাদের দুষ্টু হাসছে। দুষ্টুর মায়াবি চোখ থেকে আমি নজর সরাবো কি করে। এই ষোল বছরে দুষ্টুর সাথে থেকে জেনেছি একটি পোষা প্রাণি মানুষের কতো প্রিয় হতে পারে। এই অনুভব থেকেই আমি শ্রীমঙ্গলে সীতেশ বাবুর ‘বন্যপ্রাণি সেবা ফাউন্ডেশন’ স্থাপনে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। শেল্টেক পুরস্কারের অর্থের অর্ধেকটা দেয়া ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে সামাজিক দায়িত্ববোধের আওতায় সহযোগিতা করতে অনুপ্রাণিত করেছিলাম। আজ এই ফাউন্ডেশনের স্থাপিত চিড়িয়াখানায় শত শত দর্শনার্থী, বিশেষ করে শিশুরা নিয়মিত আসে এবং প্রাণিকূলের প্রতি সমতাবদ্ধ হয়। তাছাড়া, সম্প্রতি প্রকাশিত আমার ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’ বইটিও আমি দুষ্টুকে উৎসর্গ করেছি। আশা করি বইয়ের পাতায় টিকে থাকবে আমাদের প্রিয় দুষ্টু। আমাদের সুখ দুঃখের সাথী ‘দুষ্টুমনা’ তুমি বেঁচে থাকবে আমাদের স্মৃতিতে। তোমার স্বস্তিময় সান্নিধ্যের ঋণ যে আমরা কিছুতেই শোধ করতে পারবো না। ভালো থেকো। সুখে থেকো।
লেখক: অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. আতিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।