করোনাকালে স্কুলগামী শিশু ভাবনা
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৪৮:৩৯,অপরাহ্ন ২৭ এপ্রিল ২০২১ | সংবাদটি ৩৪৪ বার পঠিত
ইছমত হানিফা চৌধুরী :
চলো সবাই পড়তে যাই, শিক্ষা ছাড়া উপায় নাই। কথায় আছে, শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ডহীন প্রাণী যেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি অশিক্ষিত জাতি বিশ্বদরবারে ঠাঁই করে নিতে পারে না। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতির শিক্ষিত জনশক্তি তৈরির কারখানা। কিন্তু আজ প্রায় চৌদ্দমাস হতে চললো মহামারি করোনার কারণে সবকিছুর মতো স্কুল কলেজ অর্থাৎ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনে হয় কোনভাবেই সামাজিক দূরত্ব মানা সম্ভব নয়, আবার স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ক্লাস নেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয় আমাদের বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি শিক্ষাথীদের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের থেকে মাধ্যমিক স্তরের সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, কোভিড উনিশ এর কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায়, গত শিক্ষাবর্ষে ও ক্লাস পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন হয়েছে বিকল্প পদ্ধতিতে। যাদের বয়স গত বৎসর বা এই পাঁচ হয়েছে কিংবা যারা স্কুলে ভর্তি হয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করবে তাদের অবস্থা আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে প্রশ্নবোধক। হয়তো স্কুলের খাতায় নাম লিখা হয়েছে, ঠিকই কিন্তু স্কুল ক্লাস এসবের কিছুই এই শিক্ষার্থীরা পেল না। সময় খারাপ শুধু আমাদের দেশ নয় সারা বিশ্ব এই সমস্যা সমানভাবে বিরাজ করছে। গত প্রায় এক বৎসর আগ থেকে ভয়ে আতঙ্কে করোনা নামক ভাইরাসের কারণে শিশু কিশোররা ঘর বন্দি। স্কুলের মাঠ সবুজ ঘাসের বাগান সব নিয়তি এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন যার থেকে ভাল থাকতে, বারবার গুরুত্ব সহকারে বলা হচ্ছে সবাই ঘরে থাকুন সুস্থ থাকতে হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। নিরাপদে থাকতে গিয়ে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে শিশু শিক্ষার্থীরা যদিও এই বিদ্যালয় কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে দূরশিক্ষণে শিক্ষার সুযোগের কথা বলা হয়েছে ব্যবহারে আর আকর্ষণীয় আনন্দদায়ক আর সবার সাধ্যের মধ্যে হউক।
এ অবস্থায় চলমান মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতের শিক্ষার ব্যাপক সংস্কারের পক্ষে মতামত আসছে। আশার কথা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকেও জাতীয় পাঠ্যক্রম সংস্কারের উদ্যোগের কথা জানা যাচ্ছে। হঠাৎ করে এমন পারিস্থিতি কারো জন্যই ইতিবাচক নয়। এবং এর থেকে সহসা উত্তরণের যেমন পথ নেই, তেমনি পারিবাহিত কোন পদ্ধতির শিক্ষা কতটা কাজের তা নিয়ে রয়েছে মতানৈক্য। কারোনাভাইরাস মহামারিতে দীর্ঘ সময় ঘরে বসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় অভিভাবকদের নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাদের অনেক বলেছে যে, মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষৎ শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের মতামত অনলাইন শিক্ষা আরও আকর্ষণীয় হওয়া দরকার। আবার দীর্ঘ মনিটর এর দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে কোমলমতি শিশুর চোখ স্বাস্থ্য ঝুকিতে পড়ছে। আবার যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে। কিংবা শহর বা মেগা শহরের সুবিধা বাকি আবার প্রয়োজনের তুলনায় খুব সল্প পরিসরে তা চলছে কিন্তু এই ব্যবস্থা চালিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সবার জন্য করা হয়তো সম্ভব নয়। করোনাভাইরাস মহামারি কালে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এক বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে যে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশই নিতে পারেনি।
স্কুল বন্ধ থাকায় ক্লাস পরিক্ষায় ক্লাস পরীক্ষা ও মূল্যায়নের যে বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছে তা নিয়ে নানা রকম অভিজ্ঞতা রয়েছে সংশ্লিষ্ঠ সবার সব ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বকে অনুসরণ করা সম্ভব নয় এটা স্বাভাবিক আমাদের সাধ্য এবং সামর্থের মধ্যে করতে হবে সবকিছু। যেহেতু পুরো এক বৎসর এর বেশি সময় এভাবে চলে গেছে এবং আরও সামনের সময় কিভাবে যাবে জানা নেই তাই এই পরিস্তিতি মোকাবেলায় প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষক শিক্ষার্থী আর অভিভাবকরাও চান ভবিষ্যৎতের প্রস্তুতি হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থা তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর হউক। শিশুরা গত দীর্ঘদিন থেকে স্কুল বন্ধ। শিক্ষা গ্রহণে শিশুরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেমন যেতে পারছেনা তেমনি নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ভার্চুয়াল পদ্ধতি সবার জন্য সহজলভ্য নয়। আবার এই গত দীর্ঘ চৌদ্দ মাস আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে এই পরিস্থিতি সহজে, একেবারে স্বাভাবিক হবে না। আর এই ভিতর দিয়ে শিক্ষা চলতে হবে। তাই বিজ্ঞজনের অভিমত ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে কারিকুলাম ও মূল্যায়ন পদ্ধতি আবারও সংস্করণ করা প্রয়োজন। শিক্ষা নিয়ে কিছু সংগঠন এক উল্লেখ্যযোগ্য টকশোতে বক্তারা যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তার আলোকে আমার এই লিখা। যেহেতু সব দিক বিবেচনায় বেশ কিছু সময় চলে গেছে। তাই করোনা মহামারির পর শিক্ষার্থীদের আগামীর কারিকুলাম ও মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন পরিমার্জন সংরক্ষণ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সিলেবাস কিভাবে আরও সংকীর্ণ করা যায়। তাও ভেবে দেখা যেতে পারে। এ গেল পড়াশুনা নিয়ে শিশুদের ভাবনা। আগে বেশিরভাগ শিশু আগে স্কুল বন্ধ হলে খুশি হতো। এখন মোটামুটি সবার মন খারাপ। আমার ব্যক্তিগত অভিমত শিশুদের একটা শিশু জগত আছে। সেখানে সকলের মন খারাপ স্কুলে না যাওয়া দুঃখে। ওরা সঙ্গীহীন এক একাকিত্বে পড়ে গেছে। কি করবে এই শিশুরা। নেই খেলার মাঠ, নেই স্কুল। মা-বাবা ছাড়া ওদের এই মুহূর্তে আর কেউই নেই। বলতে গেলে তারা বিশাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। সেখানে খড়কুটো আসলে মা-বাবাই। করোনা নামক একটি নতুন নামের সঙ্গে আমরা জাতিধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে পরিচিত হয়েছি। আমরা সবাই হয়তো বুঝতে পারছি না, কীভাবে মোকাবিলা করব এই কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করছি। আর এর প্রভাব পড়েছে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর। পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রায়। বড়রা নিজেদের পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারলেও শিশুরা খাপ খাওয়াতে পারছে না।
শিশুরা তাদের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, উৎকন্ঠা বড়দের মতো করে প্রকাশ করতে পারে না ফলে সহজেই অস্থিরতা, রাগ, বিরক্তি, ভয় পাওয়া ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। সুবিধা বঞ্চিতদের অবস্থা স্পষ্ট হয়ে যায়, সুবিধাবাদিদের বিষয় খেয়াল করলে এই সময়ে শিশুরা বড়দের পাশাপাশি টিভি দেখছে, ইন্টারনেটে নানা কিছু দেখছে বটে, কিন্তু তারা অনেক তথ্য বুঝতে পারছে না। ফলে বাড়ছে উদ্বেগ মা বাবা এবং পরিবারের অন্য বয়স্ক মানুষ বয়স উপযোগী এবং সহায়ক মনোভাব নিয়ে বিষয়গুলো আলোচনা করলে তাদের বুঝতে সহজ হবে এবং চিন্তা মানসিক কষ্ট কমে যাবে। আবার কখনো পরিবারের কেউ বা আশপাশে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে শিশুরা অনেক বেশি ভয় পেয়ে যাচ্ছে। শিশু মনে প্রিয় মানুষদের নিয়ে আতঙ্ক অনুভব করছে এবং সঠিকভাবে তাদের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারছে না।
এই চলমান পরিস্থিতিতে ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে শিশুদের কোভিড-১৯ এর সংক্ষিপ্ত নির্দেশিকা পর্যালোচনা করা যায়-
১। শিশুকে খোলাখুলি প্রশ্ন করে জানুন সে কোভিড-১৯ সম্পর্কে কতটুকু জানে।
২। বিষয়টি শিশুবান্ধব উপায়ে ব্যাখ্যা করুন। তাদের প্রতিক্রিয়া খেয়াল করুন এবং উদ্বেগের মাত্রা বোঝার চেষ্টা করুন। তাদের প্রতি সংবেদনশীল হোন।
৩। ছোট ছেলে মেয়েরা কীভাবে নিজেদের এবং তাদের বন্ধুদের রক্ষা করতে পারে তা দেখিয়ে দিন। হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির সময় কীভাবে কনুই দিয়ে নাক-মুখ ঢাকতে হবে তা দেখিয়ে দিন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যাদের উপসর্গ আছে, তাদের কাছে না যাওয়া জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে বলুন।
৪। টিভি বা অনলাইনে এই বিষয়ে খবর দেখে বাচ্চারা ভয় পেতে পারে তখন বাচ্চাকে নিয়ে খেলাধুলা করুন।
৫। খেয়াল করুন আপনার শিশু কোন স্টিগামার শিকার হচ্ছে কি না। শিশুকে জানান যে কোভিড-১৯ জাতি ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে যে কারও হতে পারে। মশকরা অথবা কোন হুমকির শিকার হলে সে যেন আপনাকে জানায়।
৬। সাহায্যকারী, সম্মুখযোদ্ধাদের কথা শিশুদের বলুন। সুহৃদ লোকজন পাশে আছে জানলে, শিশুরা স্বস্তি পাবে।
৭। শিশুরা খুব বিচক্ষণভাবে বড়দের অনুকরণ করে, তাই স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশিকা মেনে নিজের খেয়াল রাখুন। অভিভাবকরা নিজ শিশুরা ব্যবহারের প্রতি একটু বেশি নজর দিবেন। বিশেষ করে শিশুদের ব্যবহার দেখা গেছে বেশীরভাগ, শিশুর সমস্যা তার ব্যবহারে প্রকাশ পায়। পরিবারের নিয়মিত রুটিন বজায় রাখুন। শিশুকে যথেষ্ট সময় দিন। শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং তার মনোভাব প্রকাশ করার সুযোগ দিন।
আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। সব শেষে বলা যায়, শিশু যদি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়, তাহলে দেরি না করে অনলাইনে বা সরাসরি চিকিৎসকের সাহায্য নিন। আমরা মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে সব শারীরিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে সক্ষম হব। সব শিশুর সমান অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আগামী ভবিষ্যৎ সকল শিশুর জন্য হউক, নিরাপদ হউক সুন্দর আর সুন্দরের উপমায় সজ্জিত হউক আজকের শিশুর আগামীর পথচলা সকল শিশুর জন্য শুভ কামনা।
সূত্র : সিলেটের ডাক