চা-বাগান শ্রমিকদের ধর্মঘট
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৪১:৪১,অপরাহ্ন ১৪ আগস্ট ২০২২ | সংবাদটি ৩৪২ বার পঠিত
জাতীয় ডেস্ক : চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরী ১২০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩০০ টাকা করার দাবিতে সারাদেশের ১৬৭ টি চা বাগানে গতকাল থেকে ধর্মঘট পালন করছেন চা শ্রমিকরা। ধর্মঘট পালনকালে ঐদিন বিভিন্ন বাগানে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। এ অবস্থায় সবকটি বাগানেই বন্ধ রয়েছে পাতা তোলাসহ সব ধরনের কার্যক্রম।
উল্লেখ্য, ভারতের আসামে বাণিজ্যিক চা-চাষ শুরু হয় ১৮৩৯ সালে। বর্তমান সিলেট অঞ্চল তখন আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। আর তখনকার আসাম ও এখানকার বাংলাদেশে বাণিজ্যিক চা চাষের সূচনা ১৮৫৪ সালে। বর্তমানে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বড় বড় চা বাগানের সংখ্যা দেড় শতাধিক। এসব চা বাগান প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমি জুড়ে। এক সময় এসব চা বাগান এলাকা ছিলো জঙ্গল এবং এগুলোতে ছিলো সর্ব সাধারণের অধিকার। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা এসব ভূমির উপর তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে। আর ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে এসব জমির মালিকানা চলে আসে রাষ্ট্রের হাতে। অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী চা বাগানের জমির মালিক হয় রাষ্ট্র। প্রতিটি বাগানের মালিককে চা চাষের জমির ইজারা নিতে হয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে। এসব ঐতিহ্যবাহী চা বাগানের বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে পঞ্চগড়ে ৭টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া উত্তরবঙ্গে ছোট ছোট চা চাষের খামার আছে ৫ সহ¯্রাধিক। এসব বাগানে কাজ করে প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক। এদের মধ্যে উত্তরবঙ্গের প্রায় ২ হাজার শ্রমিক বাদে বাকী সবাই কাজ করেন ঐতিহ্যবাহী দেড় শতাধিক চা বাগানে। এসব শ্রমিকের মধ্যে নিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখের বেশী। অনিবন্ধিতদের সংখ্যা প্রায় ৩৭ হাজার। পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার এবং নারী শ্রমিক প্রায় ৭১ হাজার। এই হিসাব বাংলাদেশ চা বোর্ডের। যা-ই হোক, চা বাগানের শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে ৫ লাখের মতো মানুষ, তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশী অবাঙালি।
সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টে (সেড) ২০১৪-১৬ সালে পরিচালিত জরিপের ফলাফল অনুসারে চা বাগানে ৮০ টির মত জাতিগোষ্ঠী আছে এবং তাদের মধ্যে প্রচলিত আছে ১৩ টি ভাষা। তবে চা বাগানের শ্রমিক পরিবারগুলোর মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রিটিশ আমলে চা বাগান শুরু করতে গিয়ে আসাম বা বর্তমান বাংলাদেশের যেখানে চা-বাগান সেখানকার মানুষদের চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য পাওয়া যায়নি। আসামের স্থানীয় মানুষ ও বাঙালিরা জঙ্গল কেটে, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে চা বাগানে কাজ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলো না। তখন চা বাগানে কাজ করার জন্য আড়কাটি, মাইস্ত্রি এবং সরদার বলে পরিচিত দালাল শ্রেণীর লোকদের লাগানো হয় শ্রমিক সংগ্রহের কাজে। তারা বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক সংগ্রহ শুরু করেন। যাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে চা বাগানে কাজ করার জন্য আকৃষ্ট করা হয়, তারা হলো মূলতঃ হিন্দুদের ৪ বর্ণের বাইরে পঞ্চম শ্রেণীর মানুষ ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। ভারতবর্ষে তারা অস্পৃশ্য, দলিত, হরিজন ট্রাইবাল এসব নামে পরিচিত। তারা যখন পরিবার-পরিজন নিয়ে চা বাগানগুলোতে এলো, তখন তারা বুঝতে পারলো, তাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু ইংরেজ সাহেবরা এবং তাদের সহযোগীরা এদের নানা কৌশলে চা বাগানে আটকে দেয়।
আজকে এদেশে যেসব সুদৃশ্য বাগান দেখা যায়, সে সময় এগুলো ছিলো বাঘ, ভাল্লুক, বিষধর সাপ, মশা ও জোঁকসহ নানা বন্য প্রাণীতে পরিপূর্ণ। তখন বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে প্রাণ হারাতে হয় জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে। অনেকে মারা যায় ডায়রিয়া, কলেরা, ম্যালেরিয়া ও গুটিবসন্তসহ নানা রোগে। বর্তমান সময়ে চা বাগানের ম্যানেজাররা সুদৃশ্য ও বিশাল বাংলোয় বাস করলেও বাগানের শ্রমিকদের বাস করতে হয় কলোনীতে। এসব কলোনীর অধিকাংশ হলো কাঁচা ও নিম্নমানের। অতীতে তাদের বাসস্থান ছিলো ঝুপড়ি ঘর। গত বছর ৩ জুন চা শ্রমিকদের মজুরী নির্ধারনের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরী বোর্ড চা শ্রমিকদের নিম্নতম নগদ মজুরী চূড়ান্ত করে ১১৭-১২০ টাকায়। মজুরী বোর্ডে চা শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসেবে রামভজন কৈরি নগদ মজুরি দাবি করেন ৩০০ টাকা। আর মজুরী বোর্ড ২০১৯ ও ২০২০ সালের জন্য কার্যকর মজুরিই স্থির করে ২০২১ সালের ১৩ জুন।
নিয়োগ বৈষম্য, নারীর প্রতি সহিংসতা, মাতৃমৃত্যু, অপুষ্টি, শিক্ষায় সংকট ও রোগব্যাধি গ্রাস করে আছে চা বাগানের শ্রমিকদের।
এছাড়া আছে শ্রম আইনের লংঘন, যা শ্রমিকদের নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় চা বাগানের শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির দাবি যে অযৌক্তিক নয়, এটা সহজেই অনুমেয়। চা বাগানগুলোতে উৎপাদনও ভালো। যদিও নানা সমস্যার কথা বলে থাকে বাগান মালিকেরা। বর্তমানে নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী ও সেবার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে চা বাগান শ্রমিকদের মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হোক, একই সাথে তাদের অন্যান্য অসুবিধা ও সমস্যা দূর করা হোক, এমন প্রত্যাশা ও দাবি আমাদের।