১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় উপমহাদেশের প্রথম চা বাগানের গোড়াপত্তন। সেই থেকে চা শ্রমিকদের জীবন চলার শুরু। চা শ্রমিকদের কল্যাণের লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের যাত্রা শুরু হয়। শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যক্রম কুলাউড়ায় পরিচালনাকালীন সময়ে জনৈক এম. সোলেমান দায়িত্ব নিয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় সহ নানা তৎপরতা শুরু করেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭২ সালে রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জি এবং তার ভাই সুরেন্দ্র বুনার্জি চা শ্রমিক ইউনিয়নের দখল নেন। ১৯৮২ সালে দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্ব›দ্ব দেখা দিলে সুরেন্দ্রকে বিতাড়িত করে একক রাজত্ব কায়েম করেন রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জি। ৩৬ বছর ধরে চলে আসা বুনার্জি চক্রের নির্যাতনে পিষ্ট শ্রমিকরা এক পর্যায়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। তাদের আন্দোলনে পতন ঘটে প্রায় চার দশকের বুনার্জি আধিপত্যের। ২০০৮ সালে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে সংগ্রাম কমিটির প্রধান মাখন লাল কর্মকার সভাপতি এবং রামভজন কৈরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময়ই শ্রমিকরা তাদের জীবনে কিছুটা আলোর দেখা পান। দৈনিক মজুরি ৩১.২৫ টাকা থেকে বেড়ে হয় ৪৮ টাকা। এর বাইরেও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেতে থাকেন চা শ্রমিকরা। কিন্তু এ সুখ বেশিদিন সয়নি তাদের কপালে। এক বছরের মাথায়ই চা শ্রমিক ইউনিয়নের দখল আবারো বুনার্জি চক্রের হাতে আসে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতি দুই বছর অন্তর চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করার কথা। ২০০৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর চা শ্রমিকদের মজুরি এ ক্লাস বাগানে দৈনিক ৪৮ টাকা, বি ক্লাস বাগানে ৪৬ টাকা এবং সি ক্লাস বাগানে দৈনিক ৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ চা এসোসিয়েশন (বিটিএ) এবং চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত মজুরির মেয়াদ ছিল ২০১১ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। ২০১১ সালের ৩১ আগস্ট মজুরি সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর চা শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করলে মালিক পক্ষ ৪৮ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৫২ টাকা এবং সর্বশেষ সর্বোচ্চ মজুরি ৬৯ টাকা নির্ধারণ করেন। শ্রমিকদের অভিযোগে জানা যায়, দুই বছর অন্তর মজুরি বৃদ্ধি সংক্রান্ত চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও প্রতিবার সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শ্রমিকদের চাপে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও চুক্তিতে থাকে শুভংকরের ফাঁকি। দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকরা সাপ্তাহিক ছুটির দিনের মজুরি থেকে বঞ্চিত ছিলেন। মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবি দাওয়া বাস্তবায়নে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন নিয়ে শ্রমিক নেতারা আন্দোলন শুরু করলে ২০১৪ সনের ১০ আগস্ট দেশের ৫টি জেলার ২০টি উপজেলার ৭টি ভ্যালিতে (অঞ্চলে) ২২৭টি চা বাগানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পুনরায় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মাখন লাল কর্মকার সভাপতি ও রামভজন কৈরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঐ কমিটি নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৫ সনের ৬ অক্টোবর মজুরি ৬৯ টাকা থেকে ৮৫ টাকায় উন্নীত হয়। সম্পাদিত ঐ চুক্তির মেয়াদ ছিলো ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সলের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত।
চা শ্রমিকদের অভিযোগ, মজুরি বৃদ্ধি, চিকিৎসা, বাসস্থান, পানীয় জলসহ আনুষঙ্গিক সকল সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়ে নির্বাচিত শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা চুপ থেকে তারা মাসিক চাঁদা আদায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সর্বশেষ ২০১৮ সনে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে আবারও মাখন লাল কর্মকার সভাপতি ও রামভজন কৈরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এভাবে রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জির পারিবারিক ইউনিয়ন থেকে মাখন লাল কর্মকার ও রামভজন কৈরীর নেতৃত্বাধীন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা শ্রমিকদের কল্যাণের চেয়ে নিজেদের আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
২০১৮ সনের ২০ আগস্ট চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিক পক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদেও সম্পাদিত এক চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৮৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০২ টাকা এবং ৩২ দিনের মজুরির সমান উৎসব বোনাসের স্থলে ৪৫ দিনের মজুরির সমান উৎসব বোনাস করা হয়েছে। পাশাপাশি মালিক পক্ষের দাবি অনুযায়ী নিরিখ (পাতি উত্তোলন কলম চারা ১৬ কেজি ও খাড়া চারা ২০ কেজি) বৃদ্ধি করা ও নুন্যতম তিন দিন কাজের পরিবর্তে চারদিন কাজ করলে সাপ্তাহিক ছুটির দিনের মজুরি প্রদানের বিষয়টি নির্ধরন হয়।
শ্রীমঙ্গলের খাইছড়া চা বাগানের প্রবীণ চা শ্রমিক নেতা ও প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান পরাগ বাড়ই অভিযোগ করে বলেন, বর্তমান ইউনিয়ন নেতাদের আয়ের কোনো উৎস ছিল না। তাদের নিজস্ব জমি, জায়গা ছিল না। এখন তারা লক্ষ লক্ষ টাকা ও গাড়ি বাড়ির মালিক হয়েছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ চা বাগান শ্রমিকদের কোন উন্নয়নই হচ্ছে না। বাজার দরের সাথে মিল রেখে শ্রমিকরা মজুরি পাচ্ছেন না। এছাড়া নানা ফাঁক ফোকরে শ্রমিকদের শোষন করা হচ্ছে।
শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, মজুরি চুক্তি অনুযায়ী চা-শ্রমিকদের বার্ষিক বোনাস ৪ হাজার ৫৯০ টাকা। এর মধ্যে দুর্গা পূজায় বকেয়াসহ ৩ হাজার ৫০০ টাকা উৎসব বোনাস প্রদান করার কথা থাকলেও সকল শ্রমিককে সমান হারে উৎসব বোনাস প্রদান করা হয় না। দৈনিক মাত্র ১০২ টাকা মজুরিতে বর্তমান বাজারদরে যেখানে দু’বেলা ডাল-ভাত জুটানো দায়, সেখানে আনন্দ উৎসব করা তো দুরের কথা। তার উপর চা-বাগান কর্তৃপক্ষ দুর্গা পূজা উপলক্ষে উৎসব বোনাস প্রদানেও বৈষম্য সৃষ্টি করছেন। সেখানে চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা কোন ভ‚মিকা রাখেন না।
অভিযোগ বিষয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী নিজেরা বাড়তি কোন সুবিধা নিচ্ছে না দাবি করে বলেন, আগে শ্রমিকদের বিভিন্নভাবে ঠকানো হলেও আমরা সেখান থেকে পরিবর্তনের চেষ্টা করছি। তাছাড়া শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। চা শ্রমিকদের গ্রাচ্যুইটি নিয়েও আমরা লড়াই করছি।