বাঙ্গালী মুসলমানের বংশ পদবীর সাতকাহন (১ম পর্ব)
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৪৮:২১,অপরাহ্ন ১২ জুলাই ২০২০ | সংবাদটি ৩৭২৩ বার পঠিত
মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন : বাঙালির বংশ পদবীর ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে বৃটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমান্তরালে বাঙালির পদবীর বিকাশ ঘটেছে বলে মনে করা হয়। বাঙালির জমি- জমা বিষয় সংক্রান্ত কিছু পদবী যেমন – তালুকদার, হালদার, চৌধুরী, মজুমদার, , পোদ্দার, সরদার, প্রাামাণিক, হাজরা, হাজারী, মন্ডল, মোড়ল, মল্লিক, বিশ্বাস ইত্যাদি বংশ পদবীর রয়েছে হিন্দু -মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের একান্ত রূপ। বাঙালি মুসলমানের শিক্ষক পেশার পদবী হলো – খন্দকার, আকন্দ, নিয়াজী ইত্যাদি। আর বাঙালি হিন্দুর শিক্ষক পদবী হচ্ছে দ্বিবেদী, ত্রিবেদী, চতুর্বেদী ইত্যাদি।
বিগত ১০/১৫ বছরে এদেশে বংশ পদবীর প্রতিযোগিতামূলক ব্যবহার অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। এ যেন পৈতা পরে ব্রাহ্মন হওয়ার এক দুরন্ত প্রতিযোগিতা। কার আগে কে তার নামের পাশে খেতাব জুড়ে দেবে শেষে যদি তার জন্য আর কোন বংশ খেতাব অবশিষ্ট না থাকে, যা অতীতে কখনোই মানুষের মাঝে এ নিয়ে দৌড় ঝাপ বা প্রতিযোগিতা ছিলনা। এমনো দেখা গিয়েছে, যাদের পূর্বপুরুষ কখনোই নামের সাথে কোন বংশপদবী বা খেতাব জুড়ে দেয়নি কিংবা এজাতীয় তাদের বিশেষ কোন সনদ নেই তারা বরং এ বিষয়ে বেশী আগ্রহী। কেউ কেউ বছরে একাধিকবার পদবী পরিবর্তনও করছে এমনকি একজনের নামের পাশে দুই বা ততোধিক বংশ পদবীর ব্যবহার শুরু করেছে। কোন বংশ পদবীর ইতিহাস বা অর্থই বা কি? তা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই,খেতাব বা পদবী একটা হলেই হলো।
সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপ আমেরিকায় অর্ধশিক্ষিত, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত জনশক্তির ব্যাপক গমনের ফলে পারিবারিক ভাবে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিশাল একটি অংশের অর্থনৈতিক ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটায় তাদের কপোলে আভিজাত্যের তিলক ফোটা বসিয়ে দেয়ার এক মহা আবেগ থেকেই এধরনের মানসিকতার উদ্রেক হয়েছে বলেই ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
যা হোক, বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত বাঙ্গালী মুসলমানদের পদবীসমূহ বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। ইসলাম ধর্মের মতে কোন পদবী নেই। মুসলমানদের জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ) এর সময়কালে কোন পদবী ছিলো না। মূলত পিতার নামেই বংশের পরিচয় হয় বলে মুসলিমদের মাঝে পদবীর ভিন্নতা দেখা যায়। লেখক ও গবেষক ‘এস এম শাহনূর প্রণীত “পদবীর সাতকাহন” এ লেখেন বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত বাঙ্গালী মুসলমানদের পদবীসমূহ বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। এখানে যেমন ধর্মীয় প্রভাব বিদ্যমান তেমনই ঐতিহ্যবাহী পেশাকেও পদবী হিসেবে গ্রহণের রেওয়াজ বিদ্যমান। অনেক হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তাদের পূর্ব পদবী পরিত্যাগ করেনি তাই অনেক মুসলিম পদবীর সাথে হিন্দু পদবীর মিল পাওয়া যায়।
ধর্মীয় পদবী সমূহ : আলী,রহমান,সৈয়দ,খন্দকার,শেখ,উদ্দিন,সিদ্দিক/সিদ্দিকী,মীর,আনসারী,গাজী,চিশতী,পীর,শায়খ,ফকির,মোল্লা,নিয়াজী,শাহ,
খাজা,ফরাজি।
ভূ-সম্পত্তি সম্পর্কিত পদবী : মিঞা, চৌধুরী, তালুকদার,মজুমদার, ভুঁইয়া ও জমাদ্দার।
পেশা হিসেবে প্রাপ্ত পদবী : মাওলানা, মুফতী, কাজি, কানুনগো, কারকুন, গোলন্দাজ, দেওয়ান, নিয়াজী, খন্দকার, পাটোয়ারী, মলঙ্গী, মল্লিক, মাতব্বর, মুন্সি/মুন্সী, মুহুরী, মৃধা, লস্কর, ব্যাপারী, হাজারী, প্রামাণিক, পোদ্দার, সরদার, হাওলদার, শিকদার, জোয়ার্দার, ইনামদার ও সরকার।
তুর্কি-পার্সিয়ান পদবী : বেগ, খান ও মীর্জা।
অন্যান্য পদবী : হক, লোহানী, ঢালী, মুস্তাফী/ মুস্তাফী ও সানা।
প্রিয় পাঠক, আপনাদের জ্ঞাতার্থে পূর্বেই বলে রাখছি, বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের নামের সাথে ব্যবহৃত বংশ পদবীর আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য খেতাব সমুহের ধারাবাহিক আলোচনার আশা করছি। এ বিষয়ে আপনাদের সুচিন্তিত পরামর্শ ও মতামত অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে।
শিকদার বংশের ইতিহাস : সুলতানি আমলে কয়েকটি মহাল নিয়ে গঠিত ছিল এক একটি শিক। আরবি শিক হলো একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ। এর সঙ্গে ফারসি দার যুক্ত হয়ে শিকদার বা সিকদার শব্দের উদ্ভব হয়েছে। এরা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী রাজকর্মচারী। শব্দকোষে যাকে বলা হয়েছে শান্তিরক্ষক কর্মচারী। এরা শিক, বন্দুক বা ছড়ি বন্দুক ব্যবহার করতো বলে শিকদার উপাধী পেয়েছিল; সেই থেকে বংশ পরমপরায় শিকদার পদবীর বিকাশ ঘটে।
দুষ্টলোকের মুখে শোনা যায়, শিকদার মানে রাজা-বাদশাহর মাথায় যারা ছাতা ধরতেন, যাদেরকে বলা হতো ছত্রপতি (যথা ছত্রপতি শিবাজী)। মনে রাখা দরকার, “রাজার মাথায় যে ধরে ছাতা, তার কথায় মন্ত্রীর যায় ঘাড়গর্দান মাথা।” একালের সাথে তূলনা করলে ধরুন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস-সচিব যে রকম দাপট দেখাতে পারেন, অনেকটা সে রকম মানুষ। (চলবে…….)
পরবর্তী পর্ব : শেখ বংশের ইতিহাস …….
লেখক : মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন, শিক্ষক,লেখক,গবেষক, মানবাধিকার কর্মী ও গণমাধ্যম কর্মী