মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বাঙ্গালী ভূখা নাঙ্গা মানুষের নয়ন মনি ও ত্রাতা
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৩১:৪৬,অপরাহ্ন ১৭ নভেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ১২২১ বার পঠিত
মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন : মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, (১৮৮০-১৯৭৬) রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি মওলানা ভাসানী নামে সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন স্ব-শিক্ষিত ব্যক্তি। তাঁর জীবন ছিল গ্রাম ভিত্তিক, মতবাদ উগ্র এবং ঔপনিবেশিক রীতিনীতির প্রতি আস্থাহীন। সারা রাজনৈতিক জীবনে তিনি প্রচুর প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন এবং বেশ কিছু সাধারণ ও স্থানীয় নির্বাচনে জয়ীও হয়েছিলেন; তবে কখনও ক্ষমতায় যাওয়ার মোহে তিনি রাজনীতি করেননি। তাঁর নেতৃত্বের ভিত্তি ছিল কৃষক, শ্রমিক ,জনসাধারণ, যাদের অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে গেছেন আজীবন
মওলানা ভাসানী ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার ধনপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম চেগা মিয়া। তাঁর পিতা ছিলেন হাজী শরাফত আলী খান। স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসায় কয়েক বছর অধ্যয়ন ছাড়া তাঁর বিশেষ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। পাঁচ বছর বয়সে মক্তবে ওস্তাদের কাছে পড়ালেখায় হাতেখড়ি। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি পিতৃহীন হন এবং ১২ বছর বয়সে মা মারা যান। পিতৃস্নেহ বঞ্চিত হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে তার দুই ভাই ও এক বোনও মারা যান। ওস্তাদের কাছে মক্তবের পাঠ সমাপ্ত করেন এবং নিজ প্রচেষ্টায় উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, অসমিয়া, আরবি ও ইংরেজি ভাষা শিখেছিলেন। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন টাঙ্গাইলের কাগমারিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে। পরে তিনি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এলাকার কালা গ্রামে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
বাবা বেঁচে থাকতেই ময়মনসিংহের কল্পাগ্রামে ভাসানীকে পাঠানো হয়েছিল পীর সৈয়দ নাসিরউদ্দিন বোগদাদীর কাছে। পরবর্তী সময়ে তিনি পীর বোগদাদীর সংস্পর্শে জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। ১৯০৬ সালে বোগদাদীর মুসাফিরখানায় হক্কুল্লাহ ও হক্কুল এবাদ মিশনের কাজ জোরেশোরে চলছিল। মওলানা ভাসানী ছিলেন তার একজন যোগ্য সাগরেদ। পীর বোগদাদী বড় হুজুর এবং ভাসানী ছোট হুজুর হিসেবে পরিচিত হন। তখন থেকে তিনি তালের আঁশের টুপি ব্যবহার করা শুরু করেন।
মওলানা ১৯০৮ সালে আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি; ১৯১৫ সালে তিনি আসাম আঞ্জুমান ওলামার সভাপতি এবং ১৯১৬ সালে আসাম কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯১৯ সালে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। তখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মাওলানা আজাদ সুবহানী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। পরে তিনি টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে গিয়ে তথাকার অত্যাচারিত কৃষকদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মওলানা জমিদার প্রথাবিরোধী সংগ্রামে সাধারণ মানুষের সাহসী নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। টাঙ্গাইলের কাগমারীতে শিক্ষকতা জীবন থেকেই এ আন্দোলন শুরু করেছিলেন তিনি। ২৪ বছরের তরুণ মওলানা আসামে গিয়ে উঠলেন। সেখানে বাস্তুহারা বাঙালি জনগোষ্ঠী তাকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করে। ব্রিটিশ সরকার ঘোষিত কুখ্যাত ‘লাইন প্রথার’ বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন শুরু করেন বাঙালিদের স্বার্থে। ১৯৩১ সালের এই সময়ে তিনি ব্রহ্মপুত্রের ভাসানচরে বসবাস করতেন। ঐ এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাসানচরে বন্যার কবল থেকে বাঙালি কৃষকদের রক্ষার জন্য তিনি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে একটি বাঁধ নির্মাণ করেন। ভাসানচরের জনসাধারণ তাকে ‘ভাসানী সাহেব’ বলে অভিহিত করে এবং পরবর্তীকালে এ উপাধি তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
আসাম সরকার আইন করে এমন একটি ভৌগোলিক সীমারেখা টেনে দেয় যে বাঙালিরা ঐ সীমা অতিক্রম করে বসতি স্থাপন করতে পারত না। এ আইনের বলে স্থানীয় অসমীয়রা ‘বাঙালি খেদাও’ আন্দোলন শুরু করে।
১৯৩৭ সালে বন্যাপ্লাবিত টাঙ্গাইলে মওলানা ভাসানী এলেন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে। আস্তানা স্থাপন করলেন কাগমারীতে। শুরু হলো নতুন সংগ্রাম। জনগণের পক্ষ থেকে দাবি তুললেন সন্তোষের জমিদারি উচ্ছেদের। কাগমারীতে হজরত শাহজামানের মাজারে মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন তিনি। কিন্তু জমিদারদের চক্রান্তে এবং সরকারের আদেশে তিনি বহিষ্কৃত হয়ে আসাম চলে যেতে বাধ্য হন।
মওলানা ভাসানী ৩৫ বছর বয়সে বগুড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। বীরনগরের প্রতাপশালী জমিদারের কন্যা আলেমা খাতুন মওলানা ভাসানীর মৃত্যুশয্যা অবধি তার পাশেই ছিলেন। এ ছাড়া আরো দু’বার দ্বার পরিগ্রহ করেছেন তিনি।
১৯৩৭ সালে ভাসানী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং অচিরেই দলের আসাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। এ ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্যার মোহাম্মদ সাদউল্লাহ্র সঙ্গে মওলানা ভাসানীর সংঘর্ষ বাঁধে। ভারত বিভাগের সময় ভাসানী আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় এ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আসাম সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে এ শর্তে মুক্তি দেয় যে, তিনি আসাম ছেড়ে চলে যাবেন।আসামের ১৩ বছরের প্রবাস জীবনে আট বছরই কারাগারে কেটেছে ভাসানীর।
বাঙালিদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি আসাম আইনসভার সদস্য ছিলেন ১১ বছর। ১৯৪৬ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে টাঙ্গাইল মহকুমায় মওলানা ভাসানী নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পক্ষে যে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তার ফলে মুসলিম লীগের পক্ষে বিপুল ভোট পড়ে। ১৯৪৮ সালে আসামের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। সন্তোষের মাটিতে স্থাপন করেন তার তৎপরতার কেন্দ্র।
ভাসানী ছিলেন আপসহীন সংগ্রামী নেতা। তাই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের গণবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণ করেন। সময়োপযোগী ও অগ্রগামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মতো দূরদর্শিতার জন্য জাতীয় নেতা হিসেবে তিনি মর্যাদা লাভ করেন। ১৯৪৮ সাল থেকেই ভাসানী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলায় আসেন, কিন্তু প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতৃত্ব থেকে তাঁকে দূরে রাখা হয়। তিনি দক্ষিণ টাঙ্গাইল এলাকার উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী এবং করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করেন। কিন্তু প্রাদেশিক গভর্নর অসদুপায়ের অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করেন এবং সকল প্রার্থীকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। ১৯৪৯ সালে পন্নীর ওপর থেকে এ বাধা তুলে নেওয়া হয়, কিন্তু ভাসানীর ওপর তা বলবৎ থাকে।
১৯৪৯ সালে ভাসানী পুনরায় আসাম যান, তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে এলে মওলানা ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ১১ অক্টোবর পুরান ঢাকায় আরমানীটোলা ময়দানের জনসভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কথা ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন। ১৬ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং সেখানে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ধুবড়ি জেলে পাঠানো হয়। কিছুদিন পর মুক্তি পেয়ে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ নেতৃত্বে সংকট দেখা দেয় এবং দলের যুব-সদস্য ও ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগের ক্ষুব্ধ সদস্যরা ঢাকায় ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন এক কর্মী সম্মেলন আহবান করে। এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় স্বামীবাগের রোজ গার্ডেনে। এতে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩০০ প্রতিনিধি যোগদান করেন। ২৪ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল জন্মলাভ করে। এর সভাপতি হন মওলানা ভাসানী, এবং টাঙ্গাইলের শামসুল হক হন সাধারণ সম্পাদক। জন্মদিনে নতুন দলটি ঢাকার আরমানিটোলায় ভাসানীর সভাপতিত্বে একটি জনসভার আয়োজন করে। ঐ স্থানে দ্বিতীয় সভাটি করা হয় ১১ অক্টোবর, এবং সভা শেষে প্রদেশে দুর্ভিক্ষাবস্থার প্রতিবাদে একটি শোভাযাত্রা নিয়ে সচিবালয় অভিমুখে অগ্রসর হলে ভাসানীসহ নতুন দলের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগারে অনশনের ফলে তাঁর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় (১৯৫০)।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হন। ভাসানী এর কড়া প্রতিবাদ করেন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। রাজনৈতিকভাবে ভাসানী এতে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে ভাসানী সবচেয়ে প্রতিবাদী এবং শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে ভাসানী তখনকার পাঁচটি বিরোধী দল নিয়ে ১৯৫৩ সালে শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে মিলিত হয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করেন নির্বাচন উপলক্ষে। এরপর প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়। এ মোর্চার অপরাপর নেতা ছিলেন এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান ও হাজী মোহাম্মদ দানেশ। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে এবং মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৭টি আসন।
বারবার কারাবরণের ফলে কারাগারে কমিউনিস্টদের সঙ্গে মওলানার যোগাযোগ ঘটে এবং তিনি সমাজতান্ত্রিক মতবাদ সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে ওঠেন। কমিউনিস্টরা তাঁকে আদমজী জুটমিল মজদুর ইউনিয়নের এবং পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগের সভাপতি করে। ১৯৫৪ সালের মে দিবসে তিনি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে দুটি বৃহৎ শ্রমিক সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। ঐ বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সভাপতি হন। এর কিছুদিন পর তিনি কমিউনিস্ট প্রভাবিত আন্তর্জাতিক শান্তি কমিটির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি পদে আসীন হন এবং স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। এ সুযোগে তিনি ইউরোপের বহু দেশ ভ্রমণ করে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করেন।
ইতোমধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির দ্বন্দ্বের কারণে যুক্তফ্রন্ট ভাঙনের সম্মুখীন হয়। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তিনি এ দ্বন্দ্ব মেটাতে পারেন নি। এদিকে ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন এবং আতাউর রহমান খানকে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারেও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানার মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রস্তাবিত পাকিস্তান সংবিধানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মওলানা তীব্র প্রতিবাদ করেন। সোহরাওয়ার্দী পৃথক নির্বাচনের পক্ষপাতি ছিলেন। মওলানা তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেষা বৈদেশিক নীতিরও বিরোধিতা করেন। তিনি চেয়েছিলেন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি কেটে দেয়া নিয়ে অন্যান্য নেতার সাথে মওলানার মতবিরোধ ঘটেছিল। এ বছরই তিনি কৃষক সমিতি গঠন করেন। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দান করেন সংগ্রামী ভাসানী। ১৯৫৭ সালে কাগমারিতে আওয়ামী লীগের এক সম্মেলন আহবান করেন। ঐ সম্মেলনে তিনি সোহরাওয়ার্দীর বৈদেশিক নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন। এ মতবিরোধের কারণে দলে ভাঙন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐ বছর মওলানা ভাসানী ঢাকায় পাকিস্তানের সকল বামপন্থি দলের একটি সম্মেলন আহবান করেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি(ন্যাপ) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। তিনি এ দলের সভাপতি হন এবং এর সেক্রেটারি জেনারেল হন পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী। এ সময় থেকে মওলানা প্রকাশ্যে বামপন্থি রাজনীতি অনুসরণ করতে থাকেন।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে মওলানাকে আবার আটক করা হয়। ১৯৬৩ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মওলানা চীন ভ্রমণে যান এবং ১৯৬৪ সালে হাভানায় বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি আইয়ুব খানের প্রস্তাবিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা গঠিত নির্বাচকমন্ডলীর কঠোর বিরোধিতা করেন এবং প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের পক্ষে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৭ সালে বিশ্ব সমাজতন্ত্র সোভিয়েতপন্থি ও চীনপন্থি এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপও ভাগ হয়, এবং মওলানা চীনপন্থি দলের নেতৃত্বে থাকেন।
তিনি আইয়ুব সরকারকে সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় হিসেবে গণ্য করেন এবং আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং তাঁকে মুক্তি দানের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন।ভাসমানীর নেতৃত্বে বিরোধীদলের কঠোর আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসীন হন। রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। মওলানা নির্বাচন বয়কট করেন। ’৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণের নিন্দা জানান তিনি। ৪ ডিসেম্বর ভাসানী পল্টন ময়দানে বিরাট জনসভায় প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ১৯৭১ সালের ৯, ১০, ১১ ও ১২ মার্চ মোমেনশাহী, খুলনা ও রাজশাহীর বিশাল জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মওলানা ভাসানী ভারতে চলে যান। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে তিনি সর্বপ্রথম যে দাবিটি তোলেন তা হলো বাংলাদেশ ভূখন্ড থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ। ঐ বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি হককথা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। অচিরেই পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পত্রিকাটি অল্পদিন পরেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মওলানা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃঙখলা পরিস্থিতির অবনতি এবং খাদ্য সংকটের প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন।
১৯৭৪ সালে তিনি হুকুমত-ই-রববানী তরিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আওয়ামী লীগ সরকার এবং ভারত-সোভিয়েতের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে ছয়টি দল নিয়ে মওলানার নেতৃত্বে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। এ ফ্রন্ট ভারত-বাংলাদেশ সীমানা চুক্তি অবিলম্বে রদ এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে নির্যাতনমূলক কর্মকান্ড বন্ধ করার দাবি জানায়। ৩০ জুন মওলানাকে গ্রেপ্তার করে টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে স্বীয় বাসভবনে গৃহবন্দী করা হয়।
মওলানা ভাসানী ফারাক্কা চুক্তিকে বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থি বলে মনে করেন। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত কর্তৃক গঙ্গা নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার এবং মরণ ফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে অশীতিপর এই নেতা। সে বছর ১৬ মে রাজশাহী থেকে ফারাক্কা অভিমুখে এক লং মার্চের ঐতিহাসিক মিছিলের নেতৃত্ব দান করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ১৯৭৬ সালের ২ অক্টোবর তিনি খোদায়ী খিদমতগার নামে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন।
ব্রিটিশ আমলে অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ আসামে মওলানা ৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। বগুড়ায় হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, জয়পুরহাটে পাঁচবিবি উচ্চবিদ্যালয়, রংপুরে একটি উচ্চবিদ্যালয় ও টাঙ্গাইলে বিন্নাফৈর হাইস্কুল ও মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ এবং তার জীবনের শেষ সৃষ্টি সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি সন্তোষে একটি কারিগরি শিক্ষা কলেজ, মেয়েদের একটি স্কুল এবং একটি শিশু কেন্দ্র স্থাপন করেন। তিনি পাঁচবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ এবং কাগমারিতে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
বহু নেতাকে দেখা যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পেলে জীবদ্দশাতেই নিজের নামে, পিতা বা মাতার নামে বা কোনো আপনজনের নামে এর নামকরণ করে থাকেন। মওলানা ভাসানী নিজের বা আপনজনের নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেননি।
শিক্ষা লাভ করা নর-নারীর জন্য ফরজ। মহানবী সা:-এর এই শাশ্বত বাণী সারাজীবন মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন ভাসানী। আসামে তিনি ইতোপূর্বে ৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন।
১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ৯৬ বছর বয়সে এই সংগ্রামী মহান পুরুষ বাংলার মানুষের নয়নমণি, মজলুম জনতার কণ্ঠস্বর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ইন্তেকাল করেন। টাঙ্গাইলের সন্তোষে তাকে দাফন করা হয়।
লেখক: মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন ,
সাধারণ সম্পাদক,মানবতার জন্য ভাসানী ফাউন্ডেশন,
সভাপতি, হাওর বাঁচাও কুষক বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ,
সম্পাদক ও প্রকাশক, ঊষারবাণী ডট.কম।
তথ্য সূত্র: বাংলাপিডিয়া ও নয়াদিগন্ত