বিরোধিতার মধ্যেও আগামীকাল ১ জুলাই চালু হচ্ছে নতুন পেনশন কর্মসূচি ‘প্রত্যয়’। এই পেনশন স্কিম চালু না করার লক্ষ্যে আন্দোলন করছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আগামীকাল থেকে কর্মবিরতিতে যাওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ এই কর্মসূচি চালু করতে অনড় রয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত সংস্থাগুলোর নতুন চাকরিজীবীরা, যারা আগামী ১ জুলাই থেকে চাকরিতে যোগ দেবেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যয় পেনশন কর্মসূচিতে যোগ দিতে হবে। এসব সংস্থার নতুন চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার পর প্রচলিত পদ্ধতিতে পেনশন পাবেন না।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি আজ ৩০ জুনের মধ্যে মেনে নিতে সময় বেঁধে দিয়েছেন দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। দাবি মানা না হলে ১ জুলাই থেকে তাঁরা কর্মবিরতিতে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা গত বৃহস্পতিবার বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ১ জুলাই থেকেই প্রত্যয় কর্মসূচি চালু হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গত মার্চের মাঝামাঝি প্রত্যয় চালুর বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরপর থেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রত্যয় চালুর বিরোধিতা করে আসছেন। তবে পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রত্যয় চালুর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। শুধু স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত নয়; সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন চাকরিজীবীদের জন্যও ১ জুলাই থেকে প্রত্যয় প্রযোজ্য হবে।
চারটি আলাদা কর্মসূচি (স্কিম) নিয়ে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয় গত বছরের ১৭ আগস্ট, যা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এগুলো হচ্ছে প্রগতি, সুরক্ষা, প্রবাস ও সমতা। প্রগতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মচারীদের জন্য, সমতা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য, প্রবাস শুধুমাত্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এবং সুরক্ষা রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ঘোষণা দিয়েছেন যে, ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি নতুন কর্মসূচি চালু হবে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, চলমান চার কর্মসূচিতে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৩ জন গ্রাহক হয়েছেন, যার বিপরীতে জমা পড়েছে ৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৩ কোটি টাকা ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি সত্যিই সর্বজনীন হচ্ছে কি না, তা আগে দেখতে হবে। যদি এটি সর্বজনীন না হয় এবং বৈষম্যপূর্ণ হয়, তাহলে চালু করার বিষয়ে আরও চিন্তা করা প্রয়োজন।
প্রত্যয়ে কী থাকছে ?
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (জিপিএফ) এবং স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর প্রদেয় ভবিষ্য তহবিলে (সিপিএফ) টাকা জমা রাখেন, যার বিনিময়ে সরকার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ হারে সুদ দেয়। যেসব সরকারি কর্মচারী রাজস্ব খাত থেকে বেতন পান, তাঁরা জিপিএফে টাকা রাখেন। আর যারা রাজস্ব খাতের বাইরে থেকে বেতন পান, তাঁরা সিপিএফে টাকা রাখেন। পেনশনে যাওয়ার পর তাঁরা এই টাকা পেয়ে থাকেন।
অর্থ বিভাগ বলেছে, সিপিএফ ব্যবস্থায় কর্মচারীরা মূল বেতনের ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠান মূল বেতনের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ জমা রাখে। কিন্তু প্রত্যয় কর্মসূচিতে প্রতিষ্ঠান দেবে মূল বেতনের সমান, ১০ শতাংশ। এটি বিদ্যমান সিপিএফ ব্যবস্থার তুলনায় ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। প্রত্যয় কর্মসূচিতে একজন কর্মচারী নিজ বেতন থেকে মাসিক ২,৫০০ টাকা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান একই পরিমাণ টাকা ৩০ বছর চাঁদা দিলে, অবসরের পর, ৬০ বছর বয়স থেকে, ওই কর্মচারী মাসিক ৬২,৩৩০ টাকা হারে পেনশন পাবেন।
প্রত্যয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য কর্মচারীদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা—এ দুটির মধ্যে যেটি কম, তা তাঁদের বেতন থেকে কাটা হবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে। এই উভয় অর্থ জমা হবে পেনশন কর্তৃপক্ষের তহবিলে।
অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, ৩০ বছর ধরে মাসিক ২,৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিলে একজন কর্মচারীর বেতন থেকে জমা হবে ৯ লাখ টাকা এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা জমা করবে আরও ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ও কর্মচারীর মোট চাঁদা হবে ১৮ লাখ টাকা। যদি তিনি ৭৫ বছর বয়সে মারা যান, তাহলে ১৫ বছরে পেনশন হিসেবে পাবেন ১ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকা, যা কর্মচারীর নিজ জমার ১২ দশমিক ৪৭ গুণ।
অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, পেনশনের সুবিধা আজীবন পাওয়া যাবে, তাই এই অঙ্ক বাড়তে পারে। এছাড়া বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য মুনাফার হার বৃদ্ধি পেলে মাসিক পেনশনের পরিমাণও বাড়বে। পেনশন কর্মসূচি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত হওয়ায় এটি শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ, এবং পেনশনের অর্থ আয়করমুক্ত। এই কর্মসূচিতে নিবন্ধিত কর্মচারীরা পেনশন পাওয়ার যোগ্য হওয়ার পরের মাস থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁদের ব্যাংক হিসাবে মাসিক পেনশনের অর্থ পেয়ে যাবেন। মুঠোফোনে খুদেবার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে তাঁদের এ বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। পেনশন পেতে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনো দপ্তরে যাওয়ার বা কোনো ধরনের প্রমাণ দেখানোর প্রয়োজন হবে না।