গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের টানা অবরোধ ও বিমান হামলার কারণে চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। একদিকে প্রচণ্ড খাদ্যসংকটে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে, অন্যদিকে প্রতিদিনই বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ১০০ জন ফিলিস্তিনি, একই সময়ে অনাহারে মৃত্যু হয়েছে আরও ১০ জনের—এমনটাই জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি অভিযান শুরুর পর অপুষ্টিজনিত কারণে এখন পর্যন্ত গাজায় প্রাণ হারিয়েছেন ১১১ জন, যার অধিকাংশ মৃত্যুই ঘটেছে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবারের হামলায় নিহতদের মধ্যে অন্তত ৩৪ জন ছিলেন যাঁরা মানবিক সহায়তা নিতে এসেছিলেন। ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে তারাও নিহত হয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, চলতি বছর যেসব শিশু মারা গেছে, তাদের মধ্যে ২১ জনের বয়স ছিল পাঁচ বছরের নিচে। সংস্থাটি আরও জানায়, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত প্রায় ৮০ দিন ধরে তারা গাজায় কোনো খাদ্য সহায়তা পাঠাতে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু খাদ্যসামগ্রী প্রবেশ করলেও তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম।
এক যৌথ বিবৃতিতে মার্সি কর্পস, নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল, রিফিউজিস ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বের ১১১টি মানবিক সংগঠন বলেছে, গাজায় বর্তমানে একটি ভয়াবহ গণ-অনাহার পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সংগঠনগুলোর অভিযোগ, গাজা সীমান্তের বাইরে প্রচুর খাদ্য, পানি ও ওষুধ মজুদ থাকলেও ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞার কারণে সেগুলো উপত্যকায় প্রবেশ করানো যাচ্ছে না।
গাজার দেইর আল-বালাহ অঞ্চল থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদক তারেক আবু আজ্জুম জানিয়েছেন, “এখন ক্ষুধাও এক ধরনের মারণাস্ত্র হয়ে উঠেছে। মানুষ আর কেবল খাবারের জন্য চাচ্ছে না, বরং বাঁচার জন্য যা পাচ্ছে, তাই খাচ্ছে।” তিনি এই অবস্থাকে ‘পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “মানুষ ধীরে ধীরে চরম কষ্টে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে।”
ইসরায়েল চলতি বছরের মার্চে গাজায় সব ধরনের পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যদিও মে মাসে কিছু সহায়তা প্রবেশ করতে শুরু করে, তবে বিতরণ করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’ (GHF) এর মাধ্যমে, যা যথেষ্ট নয় বলে অভিযোগ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছে, ইসরায়েল গাজায় প্রবেশ ও প্রস্থানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে মানবিক সহায়তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। মে মাস থেকে এ পর্যন্ত শত শত ফিলিস্তিনি, যারা খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন, ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন বলেও অভিযোগ করা হয়।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) জরুরি কার্যক্রমের পরিচালক রস স্মিথ জানান, গাজায় সহায়তা কার্যক্রম চালাতে গেলে কিছু মৌলিক শর্ত নিশ্চিত করা জরুরি। বিশেষ করে, খাবার বিতরণের স্থানগুলো যেন সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি থেকে মুক্ত থাকে—এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলোর একটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফিলিস্তিন অঞ্চলের প্রতিনিধি রিক পিপারকর্ন জানান, সহায়তা নিতে যাওয়া মানুষদের ওপর হামলার কারণে অনেক হাসপাতাল এখন একেকটি বিশাল ট্রমা সেন্টারে পরিণত হয়েছে। এমনকি চিকিৎসক, শিক্ষক এবং সাংবাদিকরাও নিজেদের কাজ ঠিকভাবে করতে পারছেন না, কারণ তারাও চরম খাদ্যাভাবের শিকার।
গাজার আল-শিফা হাসপাতালের চিকিৎসক ও আমেরিকান নাগরিক নুর শরাফ বলেন, “মানুষ দিনের পর দিন না খেয়ে মারা যাচ্ছে। অনেক চিকিৎসক নিজেরাই খাবার পাচ্ছেন না, তবুও তারা অসুস্থ মানুষদের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন।”