জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান কমিশনার ভলকার তুর্ক জানিয়েছেন, বাংলাদেশে জুলাই এবং আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঘটে যাওয়া নৃশংসতা সম্পর্কে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তিনি আরো জানান, ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে।
বুধবার, ২২ জানুয়ারি, সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের সাইডলাইনে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এই তথ্য জানান। এ সময়, ভলকার তুর্ক প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগে এটি জেনেভার জাতিসংঘ অধিকার কার্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে শেয়ার করা হবে বলেও উল্লেখ করেন। জুলাই এবং আগস্টে সংঘটিত ঘটনাগুলোর তদন্ত কার্যক্রমের জন্য ড. ইউনূস জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে ধন্যবাদ জানান।
ভলকার তুর্ক জানান, প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগেই তা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শেয়ার করা হবে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ বিচারিক ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনারের কাছে আবেদন জানান যে, তারা যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আরও তথ্য এবং সুপারিশ শেয়ার করেন, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ছয়টি স্বাধীন কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং তাদের প্রতিবেদনগুলোও আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হবে। তিনি জানান, এই প্রতিবেদনগুলো একে অপরকে পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে, যা সরকারের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করবে।
এ সময়, ড. ইউনূস জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সাহায্যের জন্য আহ্বান জানান। তিনি মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ অঞ্চল গঠনের প্রস্তাব দেন, যাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তিনি বলেন, “এটা শুধুমাত্র বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক মানবিক সংকট।” তিনি জাতিসংঘের কাছে এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন, যা বিশ্বের এই ভয়াবহ মানবিক সংকটের দিকে বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণ করবে এবং সহায়তা প্রদানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একত্রিত করবে।
এ সময়, ভলকার তুর্ক তার সহমত পোষণ করে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। তিনি জানান, তিনি এ বিষয়ে জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপের সঙ্গে আলোচনা করছেন এবং এ বিষয়ে একটি সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাবও দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এ ধরনের সম্মেলন বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোযোগ পুনরায় এই সংকটের দিকে নিয়ে আসবে, যা বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”
ভলকার তুর্ক আরো বলেন, মিয়ানমার সরকারকে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার জন্য তিনি অঙ্গীকারাবদ্ধ।
ড. ইউনূস তার বক্তব্যে জাতিসংঘকে আরও আহ্বান জানান, তারা যেন রোহিঙ্গা সংকটের মানবিক দিকগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করে এবং তা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
এ সময়, বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের এসডিজি সমন্বয়কারী লামিয়া মোরশেদ এবং বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি তারেক আরিফুল ইসলাম, যারা এই আলোচনার সময় সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
এই বৈঠকটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা বাংলাদেশ সরকারের মানবাধিকার এবং শরণার্থী সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার উন্নতি ঘটাবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সহযোগিতায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের তদন্ত এবং সমাধান প্রক্রিয়া একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।
ভলকার তুর্ক এবং ড. ইউনূসের মধ্যে এই আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার একটি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে। এই বৈঠক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং সরকারের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।